আর্কষনীয় রং ও স্বাদের জন্য সব বয়সীদের কাছে তরমুজ বেশ সমাদৃত। আবার এটি যদি হয় নিজ হাতে চাষ করা নিজ ছাদ বাগান কিংবা বারান্দা বাগানের তাহলে এক অনন্য অনুভূতির সৃষ্টি হয়। অন্যান্য ফুল-ফল ফসলের মতো ছাদেও তরমুজ চাষ করা সম্ভব, এমনকি চাইলে সারা বছরও চাষ করা যাবে। এর জন্য জানা দরকার সঠিক জাত, চাষ পদ্ধতি,মাটি তৈরি, চারা তৈরি ইত্যাদি ।
সূচিপত্র –
- তরমুজের জাত পরিচিতি
- চাষের সময় ও উপযুক্ত পরিবেশ (রোদ-আলো)
- চারা তৈরি পদ্ধতি
- টব/পাত্র নির্বাচন
- টবের জন্য মাটি প্রস্তুত প্রণালী
- গাছ রোপণ পরবর্তী সার ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যা
- তরমুজ ফুল এর কৃত্রিম পরাগায়ন প্রক্রিয়া
- তরমুজ সংগ্রহ/হার্ভেস্ট
- তরমুজের রোগ-বালাই ও সমাধান
- সারা বছর তরমুজ চাষ
তরমুজের জাত পরিচিতিঃ
আমাদের দেশে চাষকৃত বেশির ভাগ জাত বিদেশি। এগুলোর মধ্যে যেমন আছে উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড তরমুজ জাত , তেমনি রয়েছে বারো মাস চাষ উপযোগী জাত ।
আমাদের আবহাওয়া উপযোগী উল্লেখযোগ্য কিছু জাত হলো –
ক্রিমসন গ্লোরী, মোহিনী,অমৃত,ক্রিমসন সুইট,সুগার বেলে,ব্লাক জায়ান্ট,গোয়ালন্দ ইত্যাদি।
বারোমাসি তরমুজ জাত– ব্লাক বেবী, ব্লাক প্রিন্স, ব্লাক বক্স, টপইল্ড,সুগার বেবি, জেসমিন-১, জেসমিন-২, জেসমিন-৩, ইত্যাদি।
নান্দনিক কিছু জাত –
কালো খোসা লাল শাঁস
হলুদ খোসা লাল শাঁস
সবুজ খোসা হলুদ শাঁস
পশ্চিমবঙ্গের পরিচিত কিছু হাইব্রিড জাত– ব্ল্যাক ক্যান্ডি , ব্ল্যাক স্টার, চেতন ,শংকর প্লাস, কাসাটা।
সাজেশন – ছাদে-বারান্দায় টবের মধ্যে তরমুজ চাষের ক্ষেত্রে বারোমাসি হাইব্রিড জাত গুলো সবচেয়ে ভালো হবে। কারণ এগুলো অল্প সময়ে ফলন দেয় , ছোট সাইজের হয়ে থাকে, বৃষ্টিতে গাছ নষ্ট হয় না।
তরমুজ চাষের সময় ও উপযুক্ত পরিবেশ (রোদ-আলো):
আমাদের দেশের আবহাওয়ায় জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত তরমুজ চাষের সময়। তবে উত্তম সময় হলো জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বীজ বপন বা চারা রোপণ করা।
তবে আগাম চাষ করতে হলে জানুয়ারির প্রথমেই চারা রোপণ করতে হবে। কিন্তু, জানুয়ারির প্রথম দিকে অধিক শীতের সময় বীজ বপন করলে বীজ জার্মিনেট করতে সমস্যা হয়, চারা ঠিকমতো বৃদ্ধি পায় না। এজন্য এসময় চারার বিশেষ যত্ন নিতে হয়।
বারোমাসি জাতের ক্ষেত্রে সারা বছরই বীজ বপন করা যাবে। তবে, উত্তম হলো মার্চ থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত। আর অধিক শীত ও বর্ষার সময় তরমুজ এর বীজ বপন বা চারা রোপণ থেকে বিরত থাকতে হবে।
পূর্ণ দিন রোদ-আলো পায় এমন জায়গায় তরমুজ সবচেয়ে ভালো হবে। তবে তরমুজ চাষের জন্য মিনিমাম ৪ ঘন্টা রোদ পায় এমন জায়গা বাছাই করতে হবে।
তরমুজের চারা তৈরি পদ্ধতিঃ
টবে তরমুজ চাষ করার জন্য প্রথমে আলাদা করে চারা তৈরি করে নিতে হবে অথবা নার্সারি থেকে সংগ্রহ করতে হবে। চারা আলাদা করে টবে, সিডলিং ট্রে, সিডলিং ব্যাগ, ওয়ান টাইম গ্লাসে তৈরি করে নিতে হবে ।
বীজ মূল টবে বপন করেও চারা তৈরি করা যাবে।
সহজ চারা তৈরির ধাপ-
১. তরমুজ এর বীজ প্রথমে ৬-৮ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে।
২. তারপর টিস্যু পেপারে দিয়ে বীজ জার্মিনেট করে নিতে হবে । সাধারণত ২-৩ দিনে বীজ জার্মিনেট হয়ে যায়।
৩. জার্মিনেট করা বীজ সিডলিং ট্রে বা সিডলিং ব্যাগ বা ওয়ান টাইম গ্লাসে বা মূল টবে দিতে হবে ।
৩. ২-৩ দিন এর মধ্যে চারা বের হবে। চারার বয়স যখন ২ সপ্তাহের মতো হবে তখন মূল টবে রোপণ করতে হবে । তখন সাধারণত চারায় ৪-৫ টি পাতা থাকে ।
তরমুজ এর জন্য টব/পাত্র নির্বাচনঃ
তরমুজ চাষের জন্য প্রচুর পানি ও খাদ্য এর প্রয়োজন হয় । এজন্য ১২ ইঞ্চি টব অথবা (১০×১০) সাইজের গ্রো ব্যাগে মাত্র একটি তরমুজ গাছ লাগানো যাবে। ১২ ইঞ্চির চেয়ে ছোট টবে তরমুজ গাছ লাগানো ঠিক হবে না তারপরও কেউ চাইলে ৮-১০ লিটার আয়তনের টবে তরমুজ করতে পারবেন, এতে ফল যদিও অনেক ছোট হবে। হাফ ড্রামে ৫-৭ টি চারা লাগানো যাবে আর ২৫ লিটার আয়তনের ফলের ঝুড়ি বা ক্রেটে ২ টি চারা লাগানো যাবে।
টিপস্ – কম খরচে বা বিনা খরচে টব তৈরি করা সম্ভব । তরমুজ যেহেতু একটি স্বল্প কালীন ফসল তাই, এর চাষে টব হিসেবে চালের বস্তা বা সিমেন্টের প্লাস্টিক বস্তা ব্যবহার করা যাবে। বস্তায় আনুমানিক ১৫ কেজি মাটি ভরে একটি চারা লাগাতে হবে।
তরমুজ চাষে টবের জন্য মাটি প্রস্তুত প্রণালীঃ
(Note: ১ টেবিল চামচ= ১০-১২ গ্রাম ; ১ চা চামচ= ৪ গ্রাম ; ১ টেবিল চামচ= ৩ চা চামচ ; ১ লিটার মাটি = ১.৫ কেজি)
তরমুজ যেহেতু একটি ফলদ্বায়ী গাছ (fruiting plant) তাই এর প্রচুর খাদ্যের প্রয়োজন পরে । এজন্য মাটি তৈরিতে যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টি উপাদান দিতে হবে ।
টবের জন্য মাটি তৈরিতে –
১. দোআঁশ মাটি ৫০% , গোবর পঁচা ৩০% আর ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার করলে দোআঁশ মাটি ৬০% , ভার্মি কম্পোস্ট ২০% আর বাকি ২০% নদীর লাল বালু মেশাতে হবে । নদীর বালু না থাকলে কোকোপিট ব্যবহার করতে হবে ২০% ।
২. রাসায়নিক সার- মাটি তৈরির সময় প্রত্যেক ৫ লিটার সমান মাটিতে ১ চা চামচ টিএসপি (TSP) বা ডিএপি (DAP) সার + হাফ চা চামচ এমওপি (MOP) সার মেশাতে হবে ।
৩. এভাবে মাটি প্রস্তুত করে ১০-১৫ দিন রেখে দিতে হবে । তারপর চারা রোপণ করতে হবে।
তরমুজ গাছ রোপণ পরবর্তী সার ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যাঃ
তরমুজ চাষ এর জন্য গাছ রোপণ করার পর আরও ৩ বার সার প্রয়োগের প্রয়োজন পরে।
১. চারা রোপণ এর ১০-১৫ দিন পর ৫ লিটার সমপরিমাণ মাটির জন্য হাফ চা চামচ ইউরিয়া ও পটাস সার (MOP) মাটিতে ছিটিয়ে দিয়ে নিড়ানি দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগের পরের দিন পানি সেচ দিতে হবে।
২. একই পরিমাণ ইউরিয়া ও পটাস সার চারা রোপণ এর ৩০-৩৫ দিন পর আবার প্রয়োগ করতে হবে। এসময় ইউরিয়া প্রয়োগ না করে হাফ চা চামচ ডিএপি সার (DAP) প্রয়োগ করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
৩. পরবর্তীতে ৫৫-৬০ দিন পর (ফল ধারণের সময়) আবার হাফ চামচ ইউরিয়া,হাফ চামচ পটাস ও হাফ চামচ টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
এই তিন বারের পর আর রাসায়নিক সার প্রয়োগ এর প্রয়োজন পরে না। এতেই সবোর্চ্চ ফলন নিশ্চিত হবে । তবে, পরবর্তীতে কোন সারের অভাব জনিত লক্ষণ দেখা দিলে সে সার প্রয়োজন মতো ব্যবহার করতে হবে।
জৈব সার –
চারা রোপণের পর প্রতি ১৫ দিন পর পর ৫ লিটার সমপরিমাণ মাটির জন্য এক মুঠো করে ভার্মি কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। টবের উপরের মাটি আলগা করে জৈব সার মাটিতে ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে ।
তবে রাসায়নিক সার প্রয়োগ এর সময়কালে জৈব সার প্রয়োগ না করে পরবর্তীতে ১০-১৫ দিন অন্তর অন্তর জৈব সার ব্যবহার করলে ভালো হবে।
কিছু বিশেষ পরিচর্যা:
- গাছ রোপণের পরে প্রধান কুশি (ডাল) ৫-৬ টা পাতা ছাড়ার পর ডগা ছাঁটাই করে দিতে হবে। এতে ডাল সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
- গাছ প্রতি , প্রত্যেক ডালে ১ টি করে মোট ৩-৪ টি তরমুজ রাখতে হবে । এর বেশি বাকি সব তরমুজ ছাঁটাই করে দিতে হবে। আরও একটি বিষয় খেয়াল রাখা দরকার, তরমুজ:পাতা =১:৩০ , অর্থাৎ প্রতি ৩০ টি পাতার জন্য একটি তরমুজ রাখা উচিত।
- যদি ছাদে বা মাটিতে ছড়িয়ে তরমুজ চাষ করা হয় তাহলে ফল সরাসরি মাটির সাথে যেনো না লেগে থাকে । এরজন্য সেখানে খড় বিছিয়ে দিতে হবে বা প্লাস্টিক কোন কিছু দিতে হবে । ফল মাটির সাথে লেগে থাকলে পচেঁ যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- মাচা করে চাষ করলে তরমুজ মোটামুটি বড় হওয়ার পর সাপোর্ট এর ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে তরমুজ ছিঁড়ে পরে যেতে পারে।
তরমুজ ফুল এর কৃত্রিম পরাগায়ন প্রক্রিয়াঃ
তরমুজ ফুলে পোকা-মাকড় দ্বারা পরাগায়ন সম্পন্ন হয়ে থাকে। শহুরে ছাদ বাগানে বা উঁচু বিল্ডিং এর ছাদে পোকা-মাকড় এর আনাগোনা কম থাকায় পরাগায়ন ব্যাহত হয়। তাই কৃত্রিম পরাগায়ন করে দিতে হবে।
পরাগায়ন পদ্ধতি- তরমুজ এর পুরুষ ও স্ত্রী ফুল আলাদা হয়ে থাকে। যে ফুলের বোঁটার দিকে ছোট তরমুজ এর মতো অংশ থাকে তা স্ত্রী ফুল আর না থাকলে তা পুরুষ ফুল।
পুরুষ ফুল এর পরাগধানীতে রং তুলির ছোট ব্রাশ বা কটন বাড দিয়ে আলতো করে ঘসে যথেষ্ট পরাগরেণু মাখিয়ে নিতে হবে। তারপর স্ত্রী ফুলের গর্ভমুন্ডে পরাগরেণু আলতো করে ঘসে লাগিয়ে দিতে হবে।
তরমুজের ফুল খুব ভোর থেকে সকালের মধ্যে ফুটে যায়। তাই পরাগায়ন এর উত্তম সময় হলো সকাল বেলার ৬-৭ টার মধ্যে সময়টুকু। তবে সকাল পর্যন্ত সময়ে পরাগায়ন করা যাবে ।
তরমুজ সংগ্রহ/হার্ভেস্টঃ
চারা রোপণ এর ১ মাসের মধ্যে তরমুজ গাছে ফুল চলে আসে। আর ফল ধারণের ৫০-৬০ দিনের মধ্যে তরমুজ পরিপক্ক হয়ে যায়, অর্থাৎ উত্তোলন উপযোগী হয়ে যায়। তরমুজ পাকার পর সরাসরি কোন বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় না, তারপরও কিছু লক্ষণ দেখে তরমুজ পাকার সময় অনুমান করা যায়।
এগুলো হলো –
- ফলের বোঁটার সঙ্গে যে আকর্ষী থাকে তা শুকিয়ে বাদামি রঙের হয়ে যায়।
- ছোট অবস্থায় খোসার উপর যে লোমশ ভাব থাকে তা পরিপক্ক হলে থাকে না। পাকা তরমুজের খোসা চকচকে হয়ে থাকে।
- পরিপক্ক ফলে আঙ্গুল দিয়ে টোকা দিলে ড্যাব ড্যাব শব্দ হয় । আর অপরিপক্ব ফলের বেলায় ধাতবীয় শব্দ হয়।
তরমুজের রোগ-বালাই ও সমাধানঃ
তরমুজ সহ অন্যান্য সকল শাক-সবজি অল্প করে ছাদে/টবে চাষ করলে পোকা-মাকড় এর উৎপাত ব্যাপক হারে চোখে পরে । তরমুজ চাষে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে ছত্রাকজনিত বিভিন্ন রোগ ।
এখানে কিছু প্রধান রোগ/সমস্যা ও তার সমাধান উল্লেখ করা হয়েছে । এর বাইরে অন্য কোন সমস্যা আপনার গাছে পরিলক্ষিত হলে কমেন্ট করে জানাবেন, সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করব ।
১. জাব পোকা:
পূর্নাঙ্গ পোকা এবং বাচ্চা উভয়ই দেখতে ছোট আকৃতির, বাদামি অথবা বাদামি কালো রঙের। এরা দলবদ্ধ ভাবে থাকে। এগুলো খালি চোখে দেখা যায় । পাতার উল্টা পাশে পোকার উপস্থিতি বেশি থাকে।
পাতা থেকে রস চুষে খায় এবং কান্ডেও আক্রমণ করে । আক্রমণের এক পর্যায়ে পাতা-কান্ড হলুদ হয়ে শুকিয়ে যায়।
২. পাতা সুড়ঙ্গকারি পোকা (লিফ মাইনর):
লিফ মাইনর ক্ষুদ্র পোকা পাতার ভেতরের সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে। এতে পাতার মধ্যে সাদা চিকন রেখার মতো আঁকা বাঁকা দাগ পরে । দাগের প্রান্তে হলুদ কিড়া দেখা যায় । আক্রমণ বেশি হলে পাতা শুকিয়ে যায়।
৩. রেড পামকিন বিটল:
পূর্ণবয়স্ক বিটল পোকা পাতা ছিদ্র করে ফেলে। পাতার কিনারা বরাবর খাওয়া শুরু করে সম্পূর্ণ পাতা খেয়ে ফেলে । অনেক সময় ফুল ও কচি ফলেও আক্রমণ করে নষ্ট করে। ছোট চারা অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে এই পোকা।
দমন ব্যবস্থা: এই পোকা গুলো দমন করতে নিম তেল নিয়মিত স্প্রে করতে হবে। সাবান-পানি ব্যবহারে জাব পোকা কিছুটা দমন হলেও লিফ মাইনর ও রেড পামকিন বিটল পোকায় তেমন কাজ হয় না।
রেড পামকিন বিটল পোকার সংখ্যা কম থাকে ও পোকা মাঝারি আকারের হয়ে থাকে (জোনাকি পোকার মতো দেখতে)। এগুলো নিয়মিত গাছ থেকে ধরে মেরে ফেলার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে ।
তবে , আক্রমণ অধিক হলে এসব উপায়ে দমন সম্ভব হয় না , তখন রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগ এর প্রয়োজন পরে ।
রাসায়নিক কীটনাশক – ইমিডাক্লোপ্রিড , সাইপারমেথ্রিন, থাইম্যাথক্সাম, ডায়মেথোয়েট এজাতীয় কীটনাশক এর যেকোন একটি প্রয়োগে জাব পোকা, লিফ মাইনর ও রেড পামকিন বিটল পোকা দমন হবে।
৪. ফলের মাছি পোকা বা মাজরা পোকা:
স্ত্রী পোকা কচি তরমুজ এর খোসা ছিদ্র করে নিচে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে ছোট কীড়া বের হয় যা, ফল খেয়ে নষ্ট করতে থাকে । পরবর্তীতে ফলগুলো পচে যায়।
তরমুজ গাছে মাছি পোকার উপস্থিতি দেখে ও ফলের চামড়ায় কালো কালো ছিদ্র দেখে এই পোকার আক্রমণ বুঝা যায়।
দমন ব্যবস্থা:
১. কচি ফল ব্যাগিং করা। পলিথিন ব্যাগ দিয়ে ফল মুড়িয়ে দেওয়া যাতে মাছি পোকা ডিম না পাড়তে পারে ।
২. মাছি পোকার জন্য সেক্স ফেরোমন ফাঁদ পাওয়া যায়। এই ফাঁদ বাগানে স্থাপন করতে হবে, ফল ধরা শুরু হলেই।
৩. আক্রমণ অধিক হলে সাইপারমেথ্রিন বা থাইম্যাথক্সাম বা ম্যালাথিয়ন জাতীয় কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
তরমুজের ছত্রাকজনিত নানা সমস্যা ও সমাধান:
তরমুজ চাষ করতে গেলে ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া জনিত নানা সমস্যা দেখা দেয়। এদের মধ্যে কিছু সমস্যা মারাত্মক যার কারণে গাছ মারাও যেতে পারে । এখানে কিছু সমস্যা ও সমাধান বর্ণনা করা হলো:
১. গোড়াপচাঁ রোগ:
প্রথমে চারার গোড়ার চারদিকে সাদা ছত্রাকজালি সহ পানি ভেজা দাগ দেখা যায়। এর মাধ্যমে এই রোগ সনাক্ত করা যায় । পরবর্তীতে শিকড় পচে যায়, গাছ নেতিয়ে পরে মারা যায়।
এটি একটি মাটি বাহিত রোগ, স্যাতস্যাতে মাটি, অতিরিক্ত পানি দিলে এটি হতে পারে।
২. ডাউনি মিলডিউ:
বয়স্ক পাতায় প্রথম রোগ বিস্তার হয়ে পরবর্তীতে পুরো গাছে ছড়িয়ে যায় এই রোগ । এরোগে পাতায় সাদা বা হলদে থেকে বাদামি রং এর দাগ দেখা যায়। একসময় পাতা শুকিয়ে যায়।
৩. গামি স্টেম ব্লাইট রোগ:
পাতায় পানি ভেজা দাগ দেখা যায় আর কান্ড ফেটে গাম/আঠার মতো পর্দাথ বের হতে থাকে। আক্রমণের এক পর্যায়ে পাতা পচে নষ্ট হয়ে যায়।
দমন ব্যবস্থা:
এসব রোগের একটা প্রধান কারণ হলো স্যাতস্যাতে মাটি ও মাটিতে জলাবদ্ধতা। এছাড়াও সুষম সারের অভাবও কিছুটা দায়ী । এজন্য মাটিতে সুষম জৈব সার নিয়মিত প্রয়োগ করে যেতে হবে। প্রতি ৫ লিটার সমান মাটিতে ১৫-২০ দিন পর পর এক মুঠো করে গোবর পঁচা সার বা ভার্মি কম্পোস্ট সার ব্যবহার করা যেতে পারে। আর মাটিতে যেনো কোন ভাবেই পানি জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
আক্রমণ হওয়ার আগেই প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলা যায়-
১. বীজ বপন বা চারা রোপণ এর আগে বীজ-চারা শোধন করে নিতে হবে।
শোধন প্রক্রিয়া- প্রতি লিটার পানিতে ২-৩ গ্রাম (হাফ চা চামচ)কার্বেন্ডাজিম জাতীয় ছত্রাকনাশক মিশিয়ে তাতে ১৫-২০ মিনিট বীজ বা চারা ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর চারা মূল টবে রোপণ করে দিতে হবে। আর বীজের ক্ষেত্রে পানি ঝরিয়ে ছায়ায় রেখে শুকিয়ে নেওয়ার পর বপন করতে হবে ।
২. ফল ধরা পর্যন্ত অন্তত দুই বার বা প্রতি ১৫ দিন পর পর (কার্বন্ডাজিম +ম্যানকোজেব ) জাতীয় ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে। পুরো গাছের পাশাপাশি গোড়ার মাটিতেও ভালো করে স্প্রে করে দিতে হবে।
৩. আক্রমণ দেখা দেওয়ার প্রাথমিক অবস্থায় যত দ্রুত সম্ভব (কার্বেনডাজিম বা মেটালেক্সিল +ম্যানকোজেব) জাতীয় ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। কিন্তু আক্রমণ বেশি হলে গাছকে আর রক্ষা করা যায় না, তখন গাছ তুলে বাগান থেকে দূরে সরিয়ে ফেলতে হবে ।
সারা বছর তরমুজ চাষঃ
মৌসুম বাদে বাকি অন্য সময় তরমুজ চাষ করা যায়। মৌসুম বলতে ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস বোঝায়। অমৌসুমে অর্থাৎ সারা বছর তরমুজ চাষ করতে হলে উপরে উল্লেখিত চাষ পদ্ধতির পাশাপাশি এসব বিষয় গুলোর প্রতি জোর দিতে হবে –
- বারো মাস চাষ উপযোগী হাইব্রিড জাতের তরমুজ বীজ বা চারা সংগ্রহ করতে হব- (ব্লাক বেবী, ব্লাক প্রিন্স, ব্লাক বক্স, টপইল্ড,সুগার বেবি , ইত্যাদি)।
- মাটির সাথে অব্যষই ২০-৩০% নদীর লাল বালু মিশিয়ে মাটিকে অধিক ঝুরঝুরে করতে হবে। যাতে বর্ষায় মাটিতে পানি জমে না থাকে।
- বর্ষায় ছাদে চাষ করলে ছাউনীর ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হবে। তবে, এক্ষেত্রে বারান্দা বেশি উপযোগী, কারণ বৃষ্টির পানি কম আসে বারান্দায়, আবার ছাউনির প্রয়োজন হয় না বারান্দায়।
- তরমুজ ফুলে অব্যষই কৃত্রিম পরাগায়ন করে দিতে হবে। কারণ- বর্ষায় প্রাকৃতিক পরাগায়ন সঠিক ভাবে হয় না।
- ছত্রাকজনিত রোগের প্রকোপ দেখা যায় বর্ষায় । তাই নিয়মিত গাছ পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আর ফল মোটামুটি বড় হওয়া পর্যন্ত প্রতি ১৫ দিন পর পর প্রোটেক্টিভ জাতীয় ছত্রাকনাশক ( ম্যানকোজেব বা কপার অক্সিক্লোরাইড বা সালফার-৮০%) স্প্রে করে যেতে হবে। ছত্রাকনাশক স্প্রে করার ১৫ দিন এর মধ্যে ফল তুলা যাবে না।
