টমেটো চাষ পদ্ধতি|ছাদে-বারান্দায় সারা বছর টমেটো চাষ

টমেটো সবার পরিচিত একটি সবজি যা কাঁচা,পাকা উভয় অবস্থায় রান্না সহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়। টমেটোর খাদ্যমান অতি উচ্চ এর পাশাপাশি আর্কষনীয় রং,আকার ও স্বাদের জন্য সব বাগানিই কম বেশি টমেটো চাষ করে থাকেন। আর বিপুল পরিমাণ টমেটো ব্যবহার করা হয় টমেটো কেচাপ,সস, চাটনি,জুস, পাউডার,পেষ্ট তৈরিতে । 

সূচিপত্র – 

  • টমেটোর জাত পরিচিতি 
  • টমেটো চাষ এর সময় ও উপযুক্ত জাত সমূহ 
  • টমেটো চাষ এর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ (রোদ-আলো)
  • টমেটোর চারা তৈরি 
  • টব/পাত্র নির্বাচন 
  • টবের জন্য মাটি প্রস্তুত প্রণালী 
  • গাছ রোপণ পরবর্তী সার ব্যবস্থাপনা
  • টমেটো উত্তোলন/হার্ভেস্ট 
  • টমেটোর রোগ-বালাই ও সমাধান 
  • শীত ব্যতিত অন্য সময় টমেটো চাষ 

টমেটোর জাত পরিচিতি:

বর্তমানে টমেটোর অনেক উন্নত জাত – হাইব্রিড,বারোমাসী,রোগ প্রতিরোধী ইত্যাদি সৃষ্টি করা হয়েছে। টমেটোর প্রায় সব জাতের জীবনকাল ৪-৬ মাসের মতো । তবে জংলি বেগুন গাছে গ্রাফটিং করে টমেটো চাষ করা হচ্ছে বর্তমানে আর এসব গাছ ১২ মাস পর্যন্ত এমনকি এর চেয়ে বেশি সময়ও টিকে থাকতে পারে। 

আকার ভেদে বিভিন্ন জাত রয়েছে যেমন- আঙ্গুরের মতো ছোট সাইজের চেরী টমেটো, এক কেজি ওজনের বীফস্টেক (Beefsteak Tomato), একদম গোলাকৃতির টমেটো যেমন রয়েছে তেমনি লম্বাকৃতির টমেটোও রয়েছে । 

টমেটোর রং বৈচিত্র্যও অনেক যেমন- লাল টকটকে টমেটো, হলুদ রং এর টমেটো, একদম কালো রং এর ব্লাক বিউটি (Black Beauty Tomato) , সাদা রং এর হোয়াইট বিউটি (White Beauty Tomato) এবং পিংক কালারের টমেটোও রয়েছে। 

ছাদে চাষের জন্য যেকোন জাত বাছাই করা যেতে পারে । আর বারান্দায় টমেটো চাষ করলে সবচেয়ে ভালো হবে চেরী টমেটো । এটি ঝোপালো গাছ হয় , অনেক বড় বড় থোকায় থোকায় টমেটো হয় যা পাকলে অনেক সুন্দর দেখায়। আবার বারান্দায় বৃষ্টির পানি কম আসে,  তাই গ্রীষ্মকালীন টমেটোও ভালো ভাবে চাষ করা যাবে বারান্দায়।

টমেটো চাষের সময় ও উপযুক্ত জাতের নাম:

বর্তমানে সারা বছর চাষ করা যায় এমন অনেক উন্নত জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে । তবে টমেটোর সবচেয়ে ভালো ফলন হয় শীত মৌসুমে । 

  • শীতে আগাম জাতের চাষ করার জন্য জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে বীজ বপন করতে হয়। উপযুক্ত জাত সমূহ – বারি টমেটো-৪, বারি টমেটো- ৫, রোমা ভিএফ, রোমারিও, টিপু সুলতান, ডেল্টা এফ-১, পুষারুবী, নিউ রূপালী F1 ইত্যাদি।
  • ভরা শীত মৌসুমে চাষ করতে চাইলে সেপ্টেম্বর- অক্টোবর মাসে বীজ বপন করতে হবে আর চারা রোপণ অক্টোবর- নভেম্বর মাসের মধ্যে শেষ করতে হবে। উপযুক্ত জাত সমূহ – মানিক, রতন, বারি টমেটো-৩, বারি টমেটো-৬, বারি টমেটো-৭, বারি টমেটো-৯, বাহার, মহুয়া ইত্যাদি । 
  • নাবি শীতকালীন জাত (Late variety) এর বীজ জানুয়ারি মাসে বপন করতে হয় । ফল পাওয়া যায় মার্চ-এপ্রিল মাস পর্যন্ত । উপযুক্ত জাত সমূহ-বাহার, রোমা ভিএফ, রাজা, সুরক্ষা ইত্যাদি।
  •  সারা বছর চাষ উপযোগী জাত এর বীজ বছরের যেকোন সময় বপন করা যাবে । তবে অতি বর্ষণের সময় বীজ বপন ও চারা রোপণ থেকে বিরত থাকতে হবে ‌। শীত ব্যতিত অন্য সময় বারোমাস চাষ উপযোগী জাত বা রোদ সহ্য (heat tolerant)  করতে পারে এমন জাত চাষ করতে হবে । উপযুক্ত জাত সমূহ – বারি টমেটো-৪, বারি টমেটো-৬, বারি টমেটো-৮ । শীতকালীন চাষযোগ্য জাত সমূহ গ্রীষ্ম-বর্ষার চাষ করলে গাছ হলেও ফুল-ফল হবে না।
  • চেরী টমেটোর শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন উভয় সময়ের চাষযোগ্য জাত রয়েছে। গ্রীষ্মকালীন চাষের জন্য (heat tolerant) জাত গুলো বাছাই করে নিতে হবে । তবে, চেরী টমেটো শীতকালেই সবচেয়ে ভালো হয় । 

তাই, বীজ বা চারা সংগ্রহের সময় ভালো করে জেনে নিতে হবে জাতের নাম , ধরণ ও আপনার নির্ধারিত সময়ে চাষ উপযোগী কিনা । 

টমেটো চাষের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ (রোদ-আলো): 

টমেটো গাছ রোদ-আলো পূর্ণ জায়গায় ভালো হয়। ছায়ায় টমেটোর ফলন ভালো হয় না তবে কিছু টমেটো ধরবে । 

মোটামুটি একটা ফলন পেতে মিনিমাম ৬ ঘন্টা রোদ পায় এমন জায়গায় গাছ রাখতে হবে । 

আর সবোর্চ্চ ফলন পেতে পূর্ণ দিন রোদ পায় এমন জায়গায় রাখতে হবে । 

তাই ,মোটামুটি সারা দিন রোদ পায় এমন জায়গা টমেটো চাষ এর জন্য নির্বাচন করুন ।‌

টমেটোর চারা তৈরির সহজ উপায়: 

টবে টমেটো চাষ করার জন্য প্রথমে আলাদা করে চারা তৈরি করে নিতে হবে অথবা চারা নার্সারি থেকে সংগ্রহ করতে হবে। চারা আলাদা করে টবে, সিডলিং ট্রে,  সিডলিং ব্যাগ, ওয়ান টাইম গ্লাসে তৈরি করে নিতে হবে । 

বীজ মূল টবে বপন করে চারা তৈরি না করে আলাদা করে অন্য টবে চারা করে নিয়ে পরে মূল টবে রোপণ করলে গাছের জীবনীশক্তি বৃদ্ধি পায়। 

চারা তৈরির জন্য – 

টমেটোর বীজ প্রথমে টিস্যু পেপার এর মাধ্যমে জার্মিনেট করে নিতে হবে । তবে, টমেটোর বীজ অনেক ছোট হওয়ায় টিস্যু পেপার দিয়ে জার্মিনেট না করে মাটিতে দিয়ে জার্মিনেট করলে ভালো হবে।  

জার্মিনেট করা বীজ সিডলিং ট্রে বা সিডলিং ব্যাগে দিতে হবে । 

২-৩ দিন এর মধ্যে চারা বের হবে। চারার বয়স যখন ৩০-৩৫ দিন হবে তখন মূল টবে রোপণ করতে হবে । তখন সাধারণত চারায় ৪-৬ টি পাতা থাকে । 

টমেটোর জন্য উপযুক্ত টব/পাত্র নির্বাচন:  

টমেটো চাষ এর জন্য উপযুক্ত টব হলো ১০-১২ ইঞ্চি টব বা ৮-১০ লিটার বালতির সমান আয়তনের পাত্র বা গ্রো ব্যাগ । এর চেয়ে ছোট পাত্রেও হবে যেমন – পাঁচ লিটার এর বোতল বা এর সম আয়তনের পাত্র , আর পাঁচ লিটার এর থেকে ছোট পাত্রে টমেটো চাষ করা ঠিক হবে না । তবে, চেরী টমেটো ছোট পাত্রেও ভালো হয় । 

টব/পাত্র যতো ছোট হবে গাছের বৃদ্ধি ততো কম, ফলন ততো কম হবে । গাছ কিছু ফলন দিয়ে ঝিমিয়ে পরবে, সহজে রোগাক্রান্ত হবে । অর্থাৎ, সহজ কথায় আপনি যেমন input ( খাদ্য/মাটি ) দিবেন, গাছও তেমন output ( টমেটো/ফলন) দিবে । 

টবের জন্য মাটি প্রস্তুত প্রণালী : 

(Note: ১ টেবিল চামচ= ১০-১২ গ্রাম ; ১ চা চামচ= ৪ গ্রাম ; ১ টেবিল চামচ= ৩ চা চামচ ; ১ লিটার মাটি = ১.৫ কেজি) 

টমেটো যেহেতু একটি ফলদ্বায়ী সবজি (fruiting vegetables) তাই এর প্রচুর খাদ্যের প্রয়োজন পরে । এজন্য মাটি তৈরিতে যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টি উপাদান দিতে হবে । 

টবের জন্য মাটি তৈরিতে – 

১. দোআঁশ মাটি ৫০% , গোবর কম্পোস্ট ৩০% আর ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার করলে দোআঁশ মাটি ৬০% , ভার্মি কম্পোস্ট ২০% আর বাকি ২০% এর জন্য কোকোপিট ১০% আর নদীর লাল বালু ১০% হারে মেশাতে হবে । নদীর বালু না থাকলে কোকোপিট ব্যবহার করতে হবে ২০% । তবে কোকোপিট ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা নেই , হাতের কাছে থাকলে ব্যবহার করবেন।  

২. রাসায়নিক সার- মাটি তৈরির সময় প্রত্যেক ৫ লিটার পাত্রের সমান মাটিতে ১ চা চামচ টিএসপি (TSP) বা ডিএপি (DAP) সার + হাফ চা চামচ এমওপি (MOP) সার মেশাতে হবে । আপনি যদি সম্পূর্ণ জৈব উপায়ে চাষ করতে চান তাহলে রাসায়নিক সার ব্যবহারের দরকার নেই । এতে যদিও ফলন কম হবে। 

৩. এভাবে মাটি প্রস্তুত করে ১০-১৫ দিন রেখে দিতে হবে ‌। তারপর গাছ রোপণ করতে হবে।

গাছ রোপণ পরবর্তী সার ব্যবস্থাপনা: 

টমেটো চাষ এর জন্য গাছ রোপণ করার পর আরও দুই বার সার প্রয়োগের প্রয়োজন পরে। এতে সবোর্চ্চ ফলন নিশ্চিত হয় ( পরীক্ষিত) । 

১. চারা রোপণ এর ২০-২৫ দিন পর ৫ লিটার আয়তনের টবের সমপরিমাণ মাটির জন্য হাফ চা চামচ ইউরিয়া সার মাটিতে ছিটিয়ে দিয়ে নিড়ানি দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগের পরের দিন পানি সেচ দিতে হবে। 

২. একই পরিমাণ ইউরিয়া সার ও হাফ চা চামচ পটাস সার চারা রোপণ এর ৪৫-৫০ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে।

এই দুই বারের পর আর রাসায়নিক সার প্রয়োগ এর প্রয়োজন পরে না। এতেই সবোর্চ্চ ফলন নিশ্চিত হয় । তবে, পরবর্তীতে কোন সারের অভাব জনিত লক্ষণ দেখা দিলে সে সার প্রয়োজন মতো ব্যবহার করতে হবে।

জৈব সার – 

চারা রোপণ এর পর প্রতি ১৫ দিন পর পর ৫ লিটার বোতল বা সমপরিমাণ টবের মাটির জন্য এক মুঠো করে ভার্মি কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। টবের উপরের মাটি আলগা করে জৈব সার মাটিতে ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে । 

তবে ৪৫-৫০ দিন পর্যন্ত রাসায়নিক সার প্রয়োগ এর সময়কালে জৈব সার প্রয়োগ না করে পরবর্তীতে চারা রোপণ এর ৫০-৬০ দিন পর থেকে জৈব সার ১০-১৫ দিন অন্তর অন্তর ব্যবহার করলে ভালো হয়। 

আর যদি, সম্পূর্ণ জৈব ভাবে টমেটো চাষ করতে চান তাহলে রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে শুরু থেকেই জৈব সার প্রয়োগ করে যেতে হবে ।

টমেটো উত্তোলন/হার্ভেস্ট : 

চারা রোপণ এর ৬০ দিন এর মধ্যে ফুল/কলি আসা শুরু হয় এবং ৬০-৭০ দিনের মধ্যে টমেটো ধরা শুরু হয়। 

টমেটো কাঁচা-পাকা উভয় অবস্থায় আপনার প্রয়োজন মতো উত্তোলন করতে পারবেন। পাকা টমেটো কিছু দিন সংগ্রহ করে রাখতে চাইলে টমেটোর নিচের দিকে রং ধরা শুরু হলেই উত্তোলন করতে হবে । অত্যন্ত রসালো হওয়ায় বেশি পাকা টমেটো সহজেই নষ্ট হয়ে যায় ।  

টমেটোর রোগ-বালাই ও সমাধান : 

টমেটো সহ অন্যান্য সকল শাক-সবজি অল্প করে ছাদে/টবে চাষ করলে পোকা-মাকড় এর উৎপাত ব্যাপক হারে চোখে পরে । টমেটো চাষ এ সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে আগাম ও নাবি ধ্বসা রোগ । 

এখানে কিছু প্রধান রোগ/সমস্যা ও তার সমাধান উল্লেখ করা হয়েছে ‌। এর বাইরে অন্য কোন সমস্যা আপনার গাছে পরিলক্ষিত হলে কমেন্ট করে জানাবেন, সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করব ‌। 

১. টমেটোর পাতা কুঁকড়ানো(টমেটো লিফ কার্ল রোগ), টমেটোর বুশি স্ট্যান্ট রোগ ও টমেটোর পাতা সুড়ঙ্গকারি পোকা( লিফ মাইনর) : 

১.১ টমেটো লিফ কার্ল রোগ:  

পাতার গায়ে ঢেউয়ের মতো ভাঁজ সৃষ্টি হয় ও পাতা কুঁকড়িয়ে যায়। বয়স্ক কুঁকড়ানো পাতা পুরু ও মচমচে হয়ে যায়। আক্রান্ত গাছের ডগার পাতাগুলো ছোট ছোট গুচ্ছাকার ধারণ করে। গাছ খর্বাকৃতির হয় ও ফল ছোট হয়।

আক্রমণের মাত্রা বাড়ার সাথে সাথে পাতা মরে যায়। গাছে অতিরিক্ত শাখা-প্রশাখার সৃষ্টি হয় ও এতে গাছ ফুল, ফল ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে । 

এই রোগের কারণ ভাইরাস যা সাদা মাছি পোকার মাধ্যমে ছড়ায়। তাই, সাদা মাছি যথাসময়ে দমন করতে হবে । আর একবার রোগ হয়ে গেলে তা আর প্রতিকার করা যায় না, ভাইরাস এর কোন প্রতিষেধক নেই ।

১.২ টমেটোর বুশি স্ট্যান্ট রোগ:

 লিফ হোপার নামক পোকা দ্বারা এই ভাইরাস ছড়ায়। এতে 

গাছের উাপরের অংশ কুঁকড়িয়ে পাতা মুড়িয়ে যায় ও পাতা চামড়ার ন্যায় পুরু মনে হয়। গাছ খর্বাকৃতির হয়ে যায় । 

এই ভাইরাসের কোন প্রতিকার নেই, তাই একবার রোগ হয়ে গেলে সেটা আর ভালো হবে না। এজন্য পোকা ভাইরাস ছড়ানোর আগেই ধ্বংস করতে হবে। 

১.৩ টমেটোর পাতা সুড়ঙ্গকারি পোকা( লিফ মাইনর) : 

লিফ মাইনর ক্ষুদ্র পোকা পাতার ভেতরের সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে। এতে পাতার মধ্যে সাদা চিকন রেখার মতো আঁকা বাঁকা দাগ পরে । দাগের প্রান্তে হলুদ কিড়া দেখা যায় । আক্রমণ বেশি হলে পাতা শুকিয়ে যায়। 

সাদা মাছি ও লিফ হোপার ও লিফ মাইনর দমন: এই পোকা গুলো দমন করতে নিম তেল নিয়মিত স্প্রে করতে হবে। সাবান-পানি ব্যবহারে তেমন কাজ হয় না। 

তবে আক্রমণ অধিক হলে এসব উপায়ে দমন সম্ভব হয় না , তখন রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগ এর প্রয়োজন পরে । 

রাসায়নিক কীটনাশক – ইমিডাক্লোপ্রিড , সাইপারমেথ্রিন, থাইম্যাথক্সাম, ডায়মেথোয়েট  এজাতীয় কীটনাশক এর যেকোন একটি প্রয়োগে পোকা দমন হবে ।

২. ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ: 

এই পোকা পট বোরার নামে পরিচিত। যা ফল ছিদ্র করে ভেতরের অংশ খেয়ে ফেলে। এতে ফল নষ্ট হয়ে খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ে । এই পোকার আক্রমণ তুলনামূলক কম দেখা যায়। 

প্রতিকার : ফুল আসার পর থেকে নিয়মিত 

নিম তেল ব্যবহার করলে এই পোকা দমন হয় । এর জন্য প্রত্যেক সপ্তাহে একবার করে নিম তেল স্প্রে করতে হবে । 

তবে আক্রমণ প্রকট হলে জৈব কীটনাশক এ কাজ নাও হতে পারে । 

রাসায়নিক কীটনাশক: অধিক আক্রমণ হলে তখন রাসায়নিক কীটনাশক ব্যতিত ফসল রক্ষা করা সম্ভব হয় না । 

 এজন্য সাইপারমেথ্রিন বা এমামেকটিন বেনজোয়েট জাতীয় কীটনাশক ১২-১৫ দিন পর পর দুই-তিন বার  প্রয়োগ করলে এই পোকা সম্পূর্ণ দমন হয় ।

৩. ছত্রাকজনিত নানা সমস্যা: 

টমেটো চাষ করতে গেলে ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া জনিত নানা সমস্যা দেখা দেয়। এদের মধ্যে কিছু সমস্যা মারাত্মক যার কারণে গাছ মারাও যেতে পারে । এখানে কিছু সমস্যা ও সমাধান বর্ণনা করা হলো: 

৩.১ ব্যাক্টেরিয়াল উইল্ট বা ঢলে পড়া রোগ – 

এটি একটি মারাত্মক রোগ যার কারণে গাছ ঢলে পড়ে মরে যায় । ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট একটি মাটিবাহিত রোগ। এ রোগের জীবাণু শিকড়ের ক্ষতস্থান দিয়ে গাছে প্রবেশ করে এবং পানি-পরিবহন নালীর  মধ্যে বংশ বিস্তার করে নালী পথ বন্ধ করে দেয়। ফলে পাতা ও গাছ সবুজ থাকা অবস্থায় হঠাৎ করে নেতিয়ে বা ঢলে পড়ে। এবং কয়েক দিনের মধ্যে সবুজ অবস্থাতেই গাছ মরে যায়।

দমন ব্যবস্থা –  এ রোগের জন্য আক্রমণ হওয়ার আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে। গাছ ঢলে পড়লে সেই গাছ আর বাঁচানো সম্ভব হয় না তবে আক্রমণ এর প্রথম পর্যারে ছত্রাকনাশক (কার্বন্ডাজিম+ম্যানকোজেব)  স্প্রে করলে কাজ হতে পারে । 

প্রতিরোধ ব্যবস্থা – আক্রান্ত গাছ বাগান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে

চারা রোপণ এর আগে শোধন করে নিতে হবে । শোধন করতে এক লিটার পানিতে ১ চা চামচ (কার্বন্ডাজিম) জাতীয় ছত্রাকনাশক মিশিয়ে সেই পানিতে চারার গোড়া ১৫-২০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে । 

চারা রোপণ এর ৩০ দিন পর (কার্বন্ডাজিম+ম্যানকোজেব) জাতীয় ছত্রাকনাশক ভালো করে গাছে স্প্রে করে দিতে হবে । এক লিটার পানিতে এক চা চামচ ছত্রাকনাশক পাউডার মেশাতে হবে । 

৩.২ টমেটোর আগাম ও নাবী ধ্বসা রোগ (আর্লি ও লেইট ব্লাইট রোগ) : 

এসব টমেটোর প্রধান রোগ গুলোর মধ্যে অন্যতম। এসব রোগে টমেটোর ফলনে ব্যাপক বিপর্যয় ঘটে । 

আর্লি ব্লাইট:  এ রোগের আক্রমণে টমেটোর চারা মরে যায় এবং পাতা ও ফল ঝরে পড়ে। বয়স্ক পাতায় প্রথমে কালো বা বাদামি রংয়ের বৃত্তাকার দাগ বা এককেন্দ্রিক বলয়ের মত গাঢ় দাগ পড়ে। কান্ডে ও ফলেও অনুরূপ কুঁচকানো বাদামী থেকে কালো রঙের বয়লাকৃতি দাগ সৃষ্টি হয় এবং আক্রান্ত ফল পাকার আগেই ঝরে পড়ে।

লেইট ব্লাইট : প্রথমে পাতার উপরে ফ্যাকাশে অথবা ফিকে সবুজ রঙের গোলাকার বা এলোমেলা পানি ভেজা দাগ পড়ে। কুয়াশাচ্ছন্ন ও মেঘলা আবহাওয়ায় দাগ সংখ্যা ও আকার দ্রুত বাড়তে থাকে। এবং দাগ গুলো বাদামী থেকে কালচে রং ধারণ করে।

রোগের আক্রমণ বেশী হলে গাছের কান্ড ও সবুজ ফলেও রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। রোগের লক্ষণ দেখা দেয়ার ৩-৪ দিনের মধ্যে গাছ ঝলসে যায় । 

প্রতিকার : এই দুই রোগের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, তাহলে দমন করা সম্ভব হবে । 

রোগ লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে (ম্যানকোজেব+মেটালেক্সিল) জাতীয় ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে বা (ম্যানকোজেব+কার্বান্ডাজিম) জাতীয় ছত্রাকনাশক ব্যবহারেও কাজ হবে ‌।

নিয়মিত সেচ প্রদান করতে হবে, জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে । সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে, ভালো মানের জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। 

৪. টমেটোর ব্লোজম ইন্ড রট রোগ (Tomato Blossom End Rot): 

এটি একটি অতি পরিচিত রোগ যা প্রত্যেক বাগানীর গাছে দেখা যায়। এ রোগে ফলের প্রান্তে পানি ভেজা দাগের সৃষ্টি হয় পরে তা আস্তে আস্তে কালচে বর্ণ ধারণ করে। এতে ফল নষ্ট হয়ে যায় ও খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে যায় ।  

দমন ব্যবস্থা: টমেটোর এই রোগ নিয়ে সকলের মাঝে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। এর পিছনে কারণ হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভুল প্রচার যে, মাটিতে ক্যালসিয়ামের অভাব হলে টমেটোর ব্লোজম ইন্ড রট রোগ হয় । 

কিন্তু, টমেটোর ব্লোজম ইন্ড রট রোগ গাছে ক্যালসিয়ামের অভাবে হয় । এর মানে এই নয় যে মাটিতে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি রয়েছে ।  মাটিতে পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম থাকার পরও গাছ গ্রহণ করতে পারে না একারণেও ব্লোজম ইন্ড রট রোগ হতে পারে।

অনিয়মিত সেচ প্রদান, মাটিতে অণুখাদ্যের অভাবের কারণেই মূলত এই রোগ হয়ে থাকে। এছাড়া মাটিতে ক্যালসিয়াম এর ঘাটতি থাকলেও এই রোগ হতে পারে। এজন্য চাষের সময় ক্যালসিয়াম এর উৎস হিসেবে ডলোচুন বা জিপসাম সার প্রয়োগ করতে হবে। আর নিয়মিত সুষম জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে ১০-১৫ দিন পর পর ১২ ইঞ্চি টবের জন্য দুই মুঠো পরিমাণ। 

আর রোগ দেখা দিলে সেচ প্রদান নিয়মিত করতে হবে এবং মাটিতে জিপসাম সার বা ডলোচুন প্রয়োগ করতে হবে। 

৫. টমেটোর ফল ফেটে যাওয়া : 

মূলত অনিয়মিত সেচ প্রদান, তাপমাত্রার দ্রুত পরিবর্তন ও মাটিতে অণুখাদ্যের অভাব জনিত কারণে ফল ফেটে যেতে পারে । 

তাই , নিয়মিত সেচ প্রদান করতে হবে ও ভালো মানের জৈব সার প্রতি ১৫-২০ দিন পর পর ১২ ইঞ্চি টবের জন্য দুই মুঠো পরিমাণ প্রয়োগ করতে হবে । 

শীত মৌসুম ব্যতিত অন্য সময় টমেটো চাষ : 

গ্রাফটেড টমেটো – 

১. রুট স্টক বাছাই- রুট স্টক মানে হলো গোড়ার অংশ। টমেটোর কলমের জন্য তিত বেগুনের রুট স্টক সবচেয়ে ভালো। তবে তিত বেগুন এর অনেক গুলো প্রজাতি রয়েছে, সব প্রজাতি দিয়ে কলম করা যাবে না। শুধু মাত্র কন্টিকারি নামে পরিচিত তিত বেগুন দিয়ে কলম করতে হবে।(ছবিতে কন্টিকারি গাছ দেখানো হয়েছে)

যদি কোন কারণে কন্টিকারি গাছ পাওয়া সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে দেশি বারোমাসি সাদা বেগুন চারা রুট স্টক হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। 

২. সায়ন বাছাই- সায়ন হলো উপরের অংশ, অর্থাৎ তিত বেগুন গাছের গোড়ায় যে টমেটো গাছ কলম করা হবে তাকে সায়ন বলে। সায়ন হিসেবে বারোমাসি চাষ উপযোগী বা গ্রীষ্ম/বর্ষাকালীন টমেটো জাত বাছাই করতে হবে, যেমন- বারি টমেটো-৪, বারি টমেটো-৮ । তবে বারি টমেটো-৮ সবচেয়ে বেশি ফলন দিয়ে থাকে। 

৩. রুট স্টক ও সায়ন তৈরির সময়- মার্চ মাসে বীজ বপন করতে হয়। তবে তিত বেগুন বা রুট স্টক এর বীজ বপন ১৫ দিন আগে করতে হবে। টমেটোর বীজ বপন করতে হবে ১৫ দিন পর। 

অর্থাৎ- কলম করার সময় তিত বেগুন চারার বয়স হবে ৪৫-৫০ দিন আর টমেটোর চারার বয়স হবে ৩০ দিন। তাহলে সহজে ও সঠিকভাবে জোড়া বাঁধবে। 

তিত বেগুন চারা সিডলিং ট্রে বা পলি ব্যাগে করতে হবে। 

৪. কলম পদ্ধতি- (কাটার জন্য নতুন ধারালো ব্লেড ব্যবহার করতে হবে)। প্রথমে তিত বেগুন চারার গোড়ার দিকে ২-৩ ইঞ্চি রেখে বাকি টুকু কেটে ফেলতে হবে। এবার কাটা মাথা চির করে কেটে নিতে হবে। 

এরপর সায়ন অর্থাৎ- টমেটো চারার মাথার দিকের কুশি সহ ৪-৫ ইঞ্চি কেটে নিতে হবে। নিচের অংশ ছবিতে দেখানো ইংরেজি অক্ষর V এর মতো কেটে নিতে হবে। 

এবার সঠিকভাবে কাটা সায়ন টি তিত বেগুনের গোড়ায় বসিয়ে দিতে হবে। এরপর পলিথিন ফিতা বা গ্রাফটিং টেপ পেঁচিয়ে জোড়াটি বেঁধে দিতে হবে। বাঁধার কাজ শেষ করে গ্রাফটেড চারাটি ছায়া যুক্ত স্থানে রেখে দিতে হবে। 

৫. চারা রোপণ সময়- সাধারণত ১৪-২১ দিনেই কলম সম্পূর্ণ ভাবে জোড়া বেঁধে যায়। জোড়া বেঁধে গেলে চারা মূল জমিতে/টবে রোপণ করে দিতে হবে।

শীত ছাড়া অন্য সময় টমেটো চাষ এর ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে । 

  • উপযুক্ত জাত চাষ এর জন্য নির্বাচন করতে হবে। যেকোন জাত এর বীজ বপন বা চারা রোপণ করে দিলে ফুল-ফল নাও হতে পারে। কারণ টমেটোর ফলনে আবহাওয়া ও দিন-রাতের পার্থক্য নির্ভর করে। এজন্য শুধুমাত্র বারো মাস চাষ উপযোগী জাত চাষ করতে হবে । 
  • টমেটো গাছের দাঁড়ানো পানি সহ্য করার ক্ষমতা একদম নেই আবার অতিরিক্ত মাটি ভিজা থাকলেও গাছ মরে যেতে পারে। তাই বর্ষার সময় টমেটো গাছ এমন জায়গায় রাখতে হবে যেখানে বৃষ্টির পানি কম আসে এরজন্য উপযুক্ত হলো বারান্দা । আর মাটির পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো থাকতে হবে। 
  • মে-জুন মাসের প্রখর রোদ থেকে গাছকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এজন্য দুপুরের রোদের সময় ছাউনীর ব্যবস্থা বা এমন জায়গায় গাছ রাখতে হবে যেখানে দুপুরের রোদ আসে না। 
  • বর্তমানে জংলি বেগুনের গাছে টমেটো গাছ গ্রাফট করে চাষ করা হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে স্টক অর্থাৎ জংলি বেগুনের গোড়ায় টমেটো কলম করা হয়। এতে টমেটো গাছ ১-১.৫ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে ও ফলন দেয় । এরকম গ্রাফটেড টমেটো চারা সংগ্রহ করে বা নিজে তৈরি করে নিয়ে বছরের যেকোন সময় টমেটো চাষ করতে পারবেন । 

Leave a Reply