টবে সবজি চাষ|সবজি অনুযায়ী টব/গ্রো ব্যাগ এর সাইজ

ছাদে/বারান্দায় টবে সবজি চাষ এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সঠিক সাইজ এর পাত্র নির্বাচন । বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি রয়েছে, এগুলোর একেকটা একেক রকম। কোন টার গাছ বড় হয় আবার কোনটা ছোট, কোনটা শাক পাতা দেয় আবার কোন টা ফল জাতীয় সবজি । এসব কারণে সবজি ভেদে সঠিক মাপের টব/পাত্র নির্বাচন করতে হবে যাতে সবোর্চ্চ ফলন নিশ্চিত হয় । 

সূচিপত্র – 

  • সাধারণ কিছু সবজির প্রকার
  • টবের জন্য মাটি তৈরি প্রক্রিয়া
  • সবজি অনুযায়ী টব/গ্রো ব্যাগের সাইজ (বিস্তারিত)
  • সবজি অনুযায়ী টব/গ্রো ব্যাগের সাইজ (চার্ট)

সাধারণ কিছু সবজির প্রকার: 

কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য এর উপর ভিত্তি করে আমরা সবজি গুলোকে ভাগ করতে পারি । আর টবে সবজি চাষ এর ক্ষেত্রে একই ধরনের সবজির প্রায় কাছাকাছি পরিচর্যা ও চাষাবাদ পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়। 

১. ফল-জাতীয় সবজি – 

মরিচ, বেগুন, টমেটো,ক্যাপসিকাম । এগুলো গুল্ম জাতীয় ঝোপ এর মতো শক্ত-সামর্থ্য গাছ হয়ে থাকে। জীবনকাল ৬ মাস থেকে ১.৫-২ বছরও হয়ে থাকে। 

২. কপি জাতীয় সবজি – 

ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রোকলি,ওলকপি, কেল, ব্রাসেলস স্পাউটস , বাটারহেড লেটুস , আইসবার্গ লেটুস। 

এগুলোর গাছ মাটির কাছাকাছি থেকে বড় হতে থাকে। জীবনকাল ৪-৬ মাস হয়ে থাকে। 

৩. পাতা জাতীয় সবজি –

সব ধরনের শাক পাতা যেমন- পালং শাক, লাল শাক, মেথি শাক, ধনিয়া পাতা, পুঁই শাক, কলমি শাক, লেটুস, বাটিশাক, সুইস চার্ড, কোলার্ড গ্রিন, হেডিং মাস্টার্ড , ইত্যাদি । এজাতীয় সবজি গাছ অনেক নরম হয়ে থাকে, জীবনকাল সীমিত। 

৪. লতানো গাছের সবজি –

 শসা,করলা,ঝিঙে, ধুন্দুল,শিম , লাউ, মিষ্টিকুমড়া, কুমড়ো , কাঁকড়োল, পটল, চিচিঙ্গা । এজাতীয় সবজি গাছ লতানো হয়ে থাকে, গাছের বৃদ্ধির জন্য অবলম্বন এর ব্যবস্থা করে দিতে হয় । 

৫. কন্দ ও মূলজ সবজি – 

আলু,মূলা, গাজর, শালগম, বিটরুট, কচু , মিষ্টি আলু । এজাতীয় সবজির মাটির নিচের রুপান্তরিত মূল,কান্ড সবজি হিসেবে গ্রহণ করা হয় । গাছ অনেক নরম হয়ে থাকে ও মাটির সাথে লেগে থাকে । 

সব ধরনের সবজির জন্য টবের মাটি তৈরি প্রক্রিয়া: 

টবে সবজি চাষ এর ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো টবের জন্য মাটি তৈরি। সবজি গাছের ভিন্নতার উপর মাটিতে তার পুষ্টি চাহিদা নির্ভর করে । শাক জাতীয় সবজির ক্ষেত্রে নাইট্রোজেন সার বেশি লাগে আবার ফল জাতীয় সবজির ক্ষেত্রে ফসফরাস ও পটাসিয়াম এর চাহিদা বেশি থাকে । মূলজ জাতীয় সবজি চাষে পানির চাহিদা বেশি থাকে। 

এসব বিষয় কে মাথায় রেখে টবের মাটি তৈরি করতে হয় ।  একেক ধরনের সবজির ক্ষেত্রে একেক রকম ভাবে মাটি তৈরি ঝামেলা পূর্ণ ও ব্যয়বহুল । তাই মাটি তৈরির ক্ষেত্রে একটি কিছু স্টান্ডার্ট নিয়ম তৈরি করা হয়েছে। এই নিয়মে মাটি তৈরি করলে সব ধরনের সবজির ক্ষেত্রে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব । 

স্টান্ডার্ট নিয়ম – 

টবে সবজি চাষ এর জন্য দোআঁশ মাটি ব্যবহার করতে হবে । আর জৈব সার বেশি পরিমাণে ব্যবহার করতে হবে। জৈব সার হিসেবে গোবর পঁচা সার এর বিকল্প আর কিছু নেই । কোকোপিট ব্যবহারেও ভালো ফলাফল পাওয়া যায় । 

পদ্ধতি -১ :  দোআঁশ মাটি ৪০-৫০% + গোবর পঁচা সার ৩০-৪০%+(কোকোপিট ২০% বা ১০% কোকোপিট+১০% নদীর লাল বালু)

পদ্ধতি -২: দোআঁশ মাটি ৫০-৬০% + ভার্মি কম্পোস্ট বা ভালো মানের জৈব সার ২০-৩০% + (কোকোপিট ২০% বা ১০% কোকোপিট+১০% নদীর লাল বালু) 

পদ্ধতি -৩: দোআঁশ মাটি ৪০% + গোবর পঁচা সার ৩০%+ কোকোপিট ৩০% 

এই তিনটি পদ্ধতির মধ্যে যেকোন একটি অনুযায়ী মাটি তৈরি করে তারপর সে মাটিতে রাসায়নিক সার মেশাতে হবে । 

রাসায়নিক সার – প্রতি ৫ লিটার মাটি বা ৫ লিটার আয়তনের টব/পাত্রের মাটির সাথে ১ চা চামচ টিএসপি বা ডিএপি সার (TSP বা DAP) + ১ চা চামচ এমওপি/পটাস সার (MOP) মেশাতে হবে। 

রাসায়নিক সার মেশানোর পর মাটি ১২-১৫ দিন রেখে দিতে হবে। তারপর সবজি চারা রোপণ করতে হবে । চার রোপণ এর ১৫-২০ দিন পর ঐ একই পরিমাণ মাটিতে হাফ চা চামচ ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে।

অনেক সবজির ক্ষেত্রে চারা রোপণ এর পরও রাসায়নিক সার ও জৈব সার প্রয়োগ এর প্রয়োজন পরে । সেক্ষেত্রে সবজি অনুযায়ী প্রয়োজন মাফিক সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে । 

এভাবে মাটি তৈরি করে নিয়ে যেকোন ধরনের সবজি চাষ করা যাবে । তারপরও সবজির ধরণ অনুযায়ী কোন মাটি প্রস্তুত প্রণালী উত্তম হবে তা পরবর্তী প্যারায় উল্লেখ করা হয়েছে।

( টবে মাটির পরিমাণ থাকে সীমিত অর্থাৎ সীমিত মাটিতে পুষ্টি উপাদানও অনেকটাই সীমিত । এজন্য রাসায়নিক সার ব্যবহার করা জরুরি ।  এতে , গাছের স্বাস্থ্য সুন্দর থাকে, রোগ-পোকা মাকড় আক্রমণ কম হয় , সবোর্চ্চ ফলন নিশ্চিত হয় ।

তারপরও রাসায়নিক সার ব্যবহার আপনার ইচ্ছার উপর নির্ভর করবে, কারণ অনেকে সম্পূর্ণ জৈব উপায়ে, জৈব সার ব্যবহার করে টবে সবজি চাষ করতে চান । )

সবজি অনুযায়ী টব/গ্রো ব্যাগের সাইজ (বিস্তারিত): 

এখানে টবের সাইজ ইঞ্চিতে এবং গ্রো ব্যাগের সাইজও ইঞ্চিতে প্রকাশ করা হয়েছে ‌। অর্থাৎ,  (১০×১০) সাইজের গ্রো ব্যাগ মানে , ১০ ইঞ্চি উচ্চতা ও ১০ ইঞ্চি চওড়া বা বাসার্ধের গ্রো ব্যাগ । ) 

জমিতে সবজি চাষের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে (সারি থেকে সারির দূরত্ব, গাছ থেকে গাছের দূরত্ব) চাষ করা হয়। তেমনি টবে সবজি চাষ এর ক্ষেত্রেও একটি মিনিমাম টব/মাটির পরিমাণ দরকার আলাদা আলাদা সবজির জন্য । 

এখানে টবের সাইজ এর বিস্তারিত আলোচনার পাশাপাশি কোন পদ্ধতিতে মাটি তৈরি করতে হবে তা উল্লেখ করা হয়েছে। 

পাতা জাতীয় সবজি – 

শাক/পাতা জাতীয় সবজি (Leafy Vegetables) এর জন্য কম গভীরতার কিন্তু অধিক চওড়া পাত্র দরকার । এসব এর শিকড় মাটির বেশি গভীরে প্রবেশ করে না , মাটির উপরের দিক থেকেই পুষ্টি উপাদান শোষণ করে নেয়। সাধারণত এসব সবজি চওড়া পাত্রে ঘন করে চাষ করা হয় । 

আর মাটিতে সবসময় পর্যাপ্ত রস ( পানি ) থাকে এমন মাটি এসব সবজির জন্য বাছাই করতে হবে। এর জন্য মাটিতে ৩০% কোকোপিট ব্যবহার করে মাটি প্রস্তুত করলে সবচেয়ে ভালো হবে (পদ্ধতি -৩) । 

পালংশাক,লাল শাক, মেথি শাক, ধনিয়া পাতা,কলমি শাক – এসব সবজির জন্য আপনার চাহিদা মতো চওড়া পাত্র/গ্রো ব্যাগ বাছাই করতে হবে কিন্তু পাত্রের গভীরতা তথা মাটির গভীরতা যেনো মিনিমাম ৬ ইঞ্চি হয় । আর মাটির গভীরতা ৮-৯ ইঞ্চি হলে সবচেয়ে ভালো হবে, এর চেয়ে বেশি মাটির গভীরতা দরকার নেই। 

লেটুস,বাটিশাক(বকচয় ফ্যান),কোলার্ড গ্রিন,হেডিং মাস্টার্ড,সুইস চার্ড – এজাতীয় সবজির গাছ গুলো বড় হয়ে থাকে ‌। তাই এর জন্য আলাদা আলাদা পাত্রে চাষ করা দরকার । এগুলোর জন্য মিনিমাম ৭ ইঞ্চি টব বা (৬×৬) সাইজ গ্রো ব্যাগে একটি করে গাছ রোপণ করতে হবে।  আর চওড়া পাত্রে করতে চাইলে একটি গাছ থেকে আরেকটি গাছের মাঝে ৫-৭ ইঞ্চি দূরত্ব রেখে রোপণ করতে হবে, পাত্রের গভীরতা তথা মাটির গভীরতা মিনিমাম ৮ ইঞ্চি হতে হবে ।  

ফল জাতীয় সবজি – 

ফলদ্বায়ী সবজি ( Fruiting Vegetables) গুলোর গাছ কিছুটা বড় হয়ে থাকে। এসব গাছের জন্য খাদ্য/মাটির পরিমাণ বেশি দরকার। আবার এ সবজি গুলোর গাছ দীর্ঘদিন জীবিত থেকে ফল দিতে থাকে।  

এসব কারণে এ সবজি গুলোর চাষাবাদে এমন ভাবে মাটি প্রস্তুত করতে হবে যাতে গাছ দীর্ঘকালীন পুষ্টি উপাদান পায় । 

এর জন্য মাটি প্রস্তুত প্রণালীর (পদ্ধতি -১) সবচেয়ে উপযোগী এবং চাষাবাদের সময়কালে ১৫-২৫ দিন পর পর নিয়মিত জৈব সার উপরি প্রয়োগ করে যেতে হবে । প্রতি ৫ লিটার সমপরিমাণ মাটির জন্য এক মুঠো করে জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।

এজাতীয় সবজি গুলো চাষ করার জন্য ১২ ইঞ্চি টব ব্যবহার করা হয় । টবের চেয়ে (১২×১২) সাইজ গ্রো ব্যাগে ভালো ফলন দিবে । 

কপি জাতীয় সবজি – 

এজাতীয় সবজি গুলোর গাছ বেশি লম্বা হয় না । কিন্তু মাটির কাছাকাছি থেকে আকারে অনেক বৃদ্ধি পেতে থাকে । পূর্ণ সাইজ এর কপির ওজন ২-৩ কেজি হয়ে থাকে ‌। অপেক্ষাকৃত কম ওজনের হয় ওলকপি , হেডিং লেটুস, কেল, ব্রাসেলস স্পাউটস। 

এসব সবজি চাষে খাদ্য/মাটির পরিমাণ বেশি লাগে । তাই, (১২×১২) সাইজের গ্রো ব্যাগ এধরনের সবজি চাষে ব্যবহার করতে হবে। এর চেয়ে ছোট পাত্রেও করা যাবে , সেক্ষেত্রে কপির সাইজ অনেক ছোট হবে ‌।

লতানো গাছের সবজি – 

এধরনের সবজি গাছের বৈশিষ্ট্য হলো অবলম্বন এর উপর পেঁচিয়ে ঝোপ এর মতো হওয়া । সঠিক মাটি ও অবলম্বন দিতে পারলে এগুলো অনেক ঝোপের সৃষ্টি করে ফলন দেয় । 

করলা, শসা-খিরা,পটল,শিম,বরবটি এগুলো অপেক্ষাকৃত কম বিস্তৃত ঝোপ সৃষ্টি করে। 

অন্যদিকে মিষ্টি কুমড়া, লাউ,কুমড়া,ঝিঙা,কাঁকড়োল এসবের গাছ অনেক বিস্তৃত হয়ে থাকে । পাতার সাইজ বড় হওয়ায় জায়গাও বেশি লাগে এদের । 

তাই, এসব সবজি চাষে খাদ্য/মাটির পরিমাণ অধিক প্রয়োজন হবে । এজন্য ২০-২৫ লিটার পাত্রে এসব সবজি গাছের ১-২ টি চারা রোপণ করা যায় ‌। সবচেয়ে ভালো হয় এগুলোকে হাফ ড্রামে বা স্থায়ী বেড তৈরি করে চাষ করা । এতে পর্যাপ্ত খাদ্য উপাদান পেয়ে সবজি গাছ গুলো স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ পায় এবং যথেষ্ট ফলন দেয় ।  

কন্দ ও মূলজ সবজি – 

এধরনের সবজি গাছ বেশি বড় হয় না । গাছ গুলো নরম হয়ে থাকে এবং মাটির সাথে লেগে থেকে বৃদ্ধি পেতে থাকে ‌‌। এসব গাছের জন্য মাটি অপেক্ষাকৃত অনেক ঝুরঝুরে করে তৈরি করতে হয় ।

 তাই , মাটি তৈরিতে বেলে দোআঁশ মাটি ব্যবহার করলে ভালো হয় অথবা (পদ্ধতি -৩) এর মতো ৩০% কোকোপিট অথবা ২০% কোকোপিট ১০% নদীর লাল বালু অথবা ২০% নদীর লাল বালু মিশিয়ে মাটি তৈরি করতে হবে। আপনার হাতের কাছে যা আছে সেটাই ব্যবহার করবেন , কোকোপিটই যে ব্যবহার করতে হবে এমন না । কারণ কোকোপিট ক্রয়ে অর্থ ব্যয় করতে হয় এবং সহজলভ্য হয় না অনেক সময় ‌। 

সবজি অনুযায়ী টব/গ্রো ব্যাগের সাইজ (চার্ট) : 

চার্টে টবের সাইজ ও গ্রো ব্যাগের সাইজ আলাদা আলাদা করে দেওয়া হয়েছে । এর পাশাপাশি চারার সংখ্যাও উল্লেখ করা হয়েছে । মিনিমাম সাইজ, প্রয়োজনীয় সাইজ, সবচেয়ে ভালো সাইজ এই তিনটি ক্যাটাগরিতে টব/গ্রো ব্যাগের সাইজ দেওয়া হয়েছে ‌। 

চার্ট এর উপরের অংশে দেওয়া নির্দেশনা অংশ টুকু অব্যষই পড়ে নিবেন , তা না হলে চার্ট বুঝতে পারবেন না । 

আশা করি এরকম একটি চার্ট আপনাদের টবে সবজি চাষ এর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

চার্ট এ আপনার কাংখিত সবজির নাম না থাকলে কমেন্ট করে জানাবেন ।

Leave a Reply