বাড়িতে কোকোপিট তৈরি ও এর বিভিন্ন ব্যবহার

যাদের সময়,সুযোগ রয়েছে তারা চাইলে খুব সহজে বাড়িতে কোকোপিট তৈরি করতে পারে । এর পাশাপাশি কোকোচিপস্ , কোকোফাইবারকোকোকয়ার তৈরি করা যায় এগুলোরও বাগানে নানান ব্যবহার রয়েছে । অন্যদিকে বাজার থেকে কেনা কোকোপিট এ নানান রকম ভেজাল মিশ্রিত থাকতে পারে যা গাছের ক্ষতির কারণ হতে পারে ।

সূচিপত্র –

  • কোকোপিট কি 
  • কোকোপিট কেনো ব্যবহার করবেন 
  • কোকোপিট তৈরি প্রক্রিয়া
  • কোকোচিপস্,কোকোফাইবার তৈরি ও ব্যবহার
  • কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ) 

কোকোপিট কিঃ

 নারিকেলের খোসা থেকে তুষ হিসেবে অর্থাৎ ডাস্ট আকারে যেটা পাওয়া যাই সেটাকে কোকোপিট বা ককোডাস্ট বলা হয় । নারিকেলের খোসায় ৬৬% ডাস্ট থাকে বাকি অংশ ফাইবার হিসেবে পাওয়া যায় । কোকোপিট হালকা ওজনের এবং অধিক পানি ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন হওয়ায় বর্তমানে মাটির পরিবর্তে উদ্ভিদের বৃদ্ধি উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়াও এর রয়েছে এন্টিফাংগাল ও এন্টিব্যাকটেরিয়াল গুণ , এটির বাফার ক্ষমতাও রয়েছে এর পিএইচ লেবেল ৫.৫-৭ এর মধ্যে থাকে সবসময় । 

কোকোপিট কেনো ব্যবহার করবেন : 

১. হালকা ওজনের হওয়ায় মাটির পরিবর্তে বা মাটির সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করা হয়। ছাদ বাগানে মাটি ব্যবহার করলে ওজন অনেক বেশি হয়ে যায় এজন্য বিকল্প হিসেবে এটি ব্যবহার করে ওজন হ্রাস করা সম্ভব ।

২. এর মধ্যে দিয়ে সহজেই বাতাস চলাচল করতে পারে । এতে গাছ তার প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সহজে গ্রহণ করতে পারে। 

৩. কোকোপিট তার ওজনের ৮-১০ গুণ পানি ধরে রাখতে পারে । ফলে মিডিয়ায় অধিক সময় ধরে ভিজা ভাব বজায় থাকে ঘন ঘন পানি দেওয়ার প্রয়োজন পরে না । 

৪. এর রয়েছে এন্টিফাংগাল ও এন্টিব্যাকটেরিয়াল গুণ। যা প্রাকৃতিক ভাবে অনেক রোগ-জীবাণু দমন করে ।

৫. দীর্ঘ দিন ব্যবহার করা যায় এবং বার বার পুনঃব্যবহার করা যায় । ৬-৮ বছর পর্যন্ত ব্যবহার উপযোগী থাকে ।‌

৬. গাছ এর ভেতর দিয়ে সহজে শিকড় করতে পারে । এজন্য চারা উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে উপযোগী মিডিয়া হলো কোকোপিট । 

৭. সয়েল লেস এগ্রিকালচার এ মিডিয়া হিসেবে কোকোপিট ব্যবহার করা হয় ।‌ হাইড্রোপনিক্স , একুয়াপনিক্স চাষাবাদেও এটি বহুল ব্যবহৃত হয় । 

কোকোপিট তৈরি প্রক্রিয়া :

 বাংলাদেশ ও ভারতে নারিকেল একটি বহুল প্রচলিত ফল । তাই, সহজেই পাওয়া যায় নারিকেলের খোসা । কিছু সহজ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই নারিকেলের খোসা থেকে কোকোপিট তৈরি , এছাড়া কোকোচিপস্,কোকোফাইবার,কোকোকয়ার তৈরি করা সম্ভব ।‌

১. প্রথমে নারিকেলের খোসা ছাড়িয়ে নিতে হবে । নারিকেলের খোসার দুইটি অংশ থাকে বাইরের দিকে শক্ত অংশ আর ভেতরের দিকে নরম অংশ ।

শক্ত অংশ বাদ দিতে হবে, এটা প্রথমেই বাদ দেওয়া যায় বা পানিতে চুবিয়ে রাখার পরও বাদ দেওয়া যাবে । পানিতে চুবিয়ে রাখার পর শক্ত অংশ বাদ দেওয়া সহজ হয় ।‌

২. খোসা গুলো পানিতে চুবিয়ে রাখতে হবে ২-৩ মাস । ভালো মানের কোকোপিট যেগুলো চারা তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয় সেগুলোর জন্য এই চুবিয়ে রাখার সময় আরও বৃদ্ধি করতে হবে ।‌ নারিকেলের খোসায় বিভিন্ন লবণ উপাদান থাকে যা গাছের ক্ষতি করতে পারে । এজন্য খোসা পানিতে চুবিয়ে রাখতে হয় এতে লবণ এর কার্যক্রম কমে যায় । এছাড়াও এতে কোকোপিট কিছুটা ডিকম্পোস্ট হয়ে যায়। 

৩. পানি থেকে তুলে যদি শক্ত অংশ বাদ দেওয়া না হয় তাহলে তা বাদ দিতে হবে ।‌ পানি কিছুটা ঝরিয়ে নিয়ে যত টুকু সম্ভব ছোট ছোট টুকরায় ভাগ করে নিতে হবে হাতের সাহায্যে ।‌ তারপর কাঁচি বা দা এর সাহায্যে আরও ছোট ছোট টুকরায় ভাগ করে নিতে হবে। 

৪. ছোট টুকরো গুলোকে ব্লেন্ডার বা গ্লাইনডিঙ্ক মেশিন এর সাহায্যে ব্লেন্ড করে নিতে হবে। যদি ব্লেন্ড করা সম্ভব না হয় তাহলে দা বা কাঁচি দিয়ে অত্যন্ত ছোট ছোট টুকরায় কেটে নিতে হবে । 

৫. তারপর ফাইবার অংশ বাদ দিতে হবে শুধু ডাস্ট গুলো নিতে হবে । ককোফাইবার গুলো অন্য কাজে ব্যবহার করা যাবে ।(সামন্য ফাইবার পাওয়া যায়।) 

৬. কোকোপিট আলাদা করার পর পানিতে ধুয়ে নিতে হবে, কয়েক বার করে ধুয়ে নিতে হবে ।ধুয়ে নিলে একদম মিহি ডাস্ট গুলো দূর হয়ে যাবে, ব্যবহার উপযোগী বড় দানা থেকে যাবে ।

তারপর রোদে শুকিয়ে কোকোডাস্ট সংরক্ষণ করা যাবে বা ভিজা অবস্থায় পটিং মিডিয়ায় ব্যবহার করা যাবে ।‌

কোকোচিপস্ ,কোকোফাইবার তৈরি প্রক্রিয়া ও ব্যবহার : 

কোকোপিট তৈরি করার সময় উপজাত হিসেবে কিছু কোকোফাইবার পাওয়া যায় । আবার কোকোকয়ার , কোকোচিপস্ তৈরি করা যায় কোকোডাস্ট না বানিয়ে । 

কোকোচিপস্ তৈরি ও ব্যবহার :  

উপরে উল্লেখিত ২ নং প্রক্রিয়ায় পানিতে চুবিয়ে রাখার পর নারিকেলের খোসা গুলো পানি থেকে তুলে প্রয়োজন মতো ছোট -বড় টুকরায় ভাগ করে কোকোচিপস্ তৈরি করতে হবে।‌ 

কোকোচিপস্ সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় অর্কিড এর পটিং মিডিয়ায়। এছাড়াও ক্যাকটাসসাকুলেন্ট এর মিডিয়ায় ছোট সাইজের কোকোচিপস্ ব্যবহার করা হয় । 

কোকোফাইবার : 

কোকোপিট তৈরির সময় কিছু পরিমাণ কোকোফাইবার তৈরি হয় । কোকোফাইবার ইন্ডাস্ট্রিতে দড়ি,সোফা,পাপোচ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। আর বাগানিদের ক্ষেত্রে কোকোফাইবার দিয়ে টবের নিচের ছিদ্র বন্ধ করার জন্য ব্যবহার করা যাবে। আবার বেশি পরিমাণ কোকোফাইবার হলে তা দিয়ে মোটা দড়ি বানিয়ে মানিপ্লান্ট জাতীয় গাছের জন্য গ্রো স্টিক বানানো যায় ।

কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ) 

১. এভাবে বাড়িতে তৈরি কোকোপিট কি বাজার থেকে কেনা কোকোডাস্ট এর মতো সকল কাজে ব্যবহার করা যাবে? 

উত্তর – হ্যা , নিশ্চিত ভাবে পটিং মিক্স, চারা উৎপাদনে , ক্যাকটাস-সাকুলেন্ট মিডিয়া তৈরিতে এটি ব্যবহার করা যাবে । বাজার থেকে কেনা কোকোডাস্টে অনেক ভেজাল থাকে যেমন-খড়কুটো, কাঠের ভুসি এসব থাকে যা পটিং মিডিয়ায় ছত্রাক এর আক্রমণ ঘটায় । কিন্তু, বাড়িতে কোকোপিট তৈরি করলে এসব ভেজাল থাকে না।

২. নারিকেলের খোসা বা কোকোপিট পানিতে না চুবিয়ে রেখে কি সরাসরি ব্যবহার করা যাবে? 

উত্তর – নারিকেলের খোসায় বিভিন্ন রকমের লবণ থাকে । এগুলো অধিক পরিমাণে থাকায় তা গাছের জন্য ক্ষতিকর। এজন্য ৩-৪ মাস পানিতে ভিজিয়ে রেখে লবণ এর পরিমাণ হ্রাস করা হয়। তাই, নারিকেলের খোসা থেকে সরাসরি কোকোপিট তৈরি করে ব্যবহার করা ঠিক নয় । নারিকেলের খোসা ভিজিয়ে রাখা সম্ভব না হলে কোকোপিট তৈরির পর সেটি ২-৩ মাস পানিতে ভিজিয়ে রেখে তারপর ব্যবহার করতে হবে। 

৩. ১০০% কোকোপিট ব্যবহার করে গাছ লাগানো যাবে?

উত্তর- কোকোপিট বৃদ্ধি সহায়ক হিসেবে কাজ করলেও গাছের জন্য খাদ্য উপাদান সরবরাহ করে না । তাই শুধু কোকোপিট এ গাছ লাগানো যাবে না ।

চারা উৎপাদনের জন্য কোকোপিট এর সাথে ৩০-৪০% হারে ভার্মি কম্পোস্ট বা গোবর কম্পোস্ট মিশাতে হয়। 

৪. কত গুলো নারিকেল খোসা থেকে এক কেজি কোকোপিট পাওয়া সম্ভব ?

উত্তর- ফ্যাক্টেরিতে সাধারণত ৩০-৪০ টা নারিকেল খোসা থেকে ৫ কেজি কোকোপিট পাওয়া যায়। 

৫. কোকোপিট এর সাথে কাঠের ভুসি বা কোকোডাস্ট এর বিকল্প হিসেবে কাঠের ভুসি ব্যবহার করা যাবে? 

উত্তর – কাঠ চিরার করাত কল থেকে সংগৃহীত কাঠের ভুসি কোকোডাস্ট এর সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করা যাবে না। কাঠের ভুসির এন্টিফাংগাল গুণ নেই কোকোপিট এর মতো । তাই , কাঠের ভুসি সহজেই ছত্রাক এর জন্ম দেয় ।

৬. কোকোপিট এ উৎপাদিত ফসল মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর? 

উত্তর – কোকোপিটে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কোনো রাসায়নিক উপাদান থাকে না । তাই উৎপাদিত ফসল মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হবে না । 

৭. কোকোপিট কি গাছের খাদ্য উপাদান হিসেবে কাজ করতে পারে ?

উত্তর- কোকোপিট এর প্রধান উপাদান হলো সেলুলোজ আর লিগনিন । এগুলো দীর্ঘদিন অক্ষত অবস্থায় থাকে মাটির সাথে সহজে মিশে যায় না । এজন্য কোকোপিট সরাসরি গাছের খাদ্য উপাদান হিসেবে কাজ করে না। তবে কিছুটা ডিকম্পোস্ট করে নিলে কিছু খাদ্য উপাদান পাওয়া যায়।‌ এমনিতে কোকোপিট পানি ধরে রেখে, বাতাস চলাচল এ সাহায্য করে উপকারী অণুজীব এর কার্যক্রম বহু গুণে বৃদ্ধি করে মাটির গুণাগুণ ঠিক রাখে ।‌ এজন্য মূলত এটি ব্যবহার করা হয় । 

Leave a Reply