সাধারণভাবে শিম বলতে আমরা যে জাত গুলো বুঝে থাকি , সেগুলোর গাছ লতানো হয়ে থাকে যা মাচা করে চাষ করতে হয় । কিন্তু ঝাড় শিম চাষ করতে কোন মাচার প্রয়োজন হয় না,কারণ ঝাড় শিম এর গাছ ছোট-খাটো হয়ে থাকে, লতানো হয় না। ফলে ঝামেলা বিহীন মাচা ছাড়াই খুব সহজে ছাদে-বারান্দায় ঝাড় শিম করা যাবে ।
সূচিপত্র –
- ঝাড় শিম এর জাত পরিচিতি
- ঝাড় শিম চাষের সময় ও উপযুক্ত পরিবেশ (রোদ-আলো)
- চারা তৈরি পদ্ধতি
- টব/পাত্র নির্বাচন
- টবের জন্য মাটি প্রস্তুত প্রণালী
- গাছ রোপণ পরবর্তী সার ব্যবস্থাপনা
- শিম উত্তোলন/হার্ভেস্ট
- ঝাড় শিম এর রোগ-বালাই ও সমাধান
ঝাড় শিম এর জাত পরিচিতি :
ঝাড় শিম যা ফেন্স বীন,ফরাসী শিম,বুশ বিন(bush bean) নামেও পরিচিত, মূলত দুই রকমের-
- লতানো ঝাড় শিম (Climbing French bean)
- খাটো , ঝোপ এর মতো ঝাড় শিম (Dwarf French bean)
লতানো জাতের গাছ কিছুটা বড় হয় , দীর্ঘকালীন ফলন দেয় । চাষের জন্য মাচা , সাপোর্ট এর প্রয়োজন হয় । ছাদে-বারান্দায় চাষের জন্য উপযোগী নয় ।
খাটো-ঝোপ এর মতো জাতের ঝাড় শিমে কোন লতানো ডাল-পালা থাকে না । অল্প দিনে ফলন দেয় ও স্বল্পকালিন ফলন দিতে সক্ষম। এজন্য এক শীত মৌসুমে এই জাত অনায়াসে দুই বার চাষ করা যাবে। ছাদে-বারান্দায় মাচা বিহীন অর্থাৎ ঝামেলা বিহীন সহজে এ জাতীয় ঝাড় শিম চাষ করা যাবে ।
ঝাড় শিম সাধারণত সবুজ রং এর হয়ে থাকে। তবে হলুদ, মিষ্টি, বেগুনি,হালকা লাল ইত্যাদি আকর্ষণীয় রং এর রয়েছে।
বাংলাদেশে তিনটি উন্নত জাতের ঝাড় শিম রয়েছে । তা হলো – বারি ঝাড় শিম -১, বারি ঝাড় শিম -২, বারি ঝাড় শিম -৩ ।
এগুলোর মধ্যে বারি ঝাড় শিম -৩ জাত বীজ এর জন্য চাষ করা হয়। এর বীজ অত্যন্ত সুস্বাদু হওয়ায় ফল/শিম এর চেয়ে বীজকে সবজি হিসেবে প্রাধান্য দেওয়া হয় ।
এখানে ছোট -খাটো ঝোপ(dwarf) এর মতো জাত এর ঝাড় শিম চাষ পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে।
ঝাড় শিম চাষের সময় ও উপযুক্ত পরিবেশ (রোদ-আলো):
ঝাড় শিম একটি শীতকালীন চাষযোগ্য সবজি । পানি সহ্য করতে পারে না ও বৃষ্টিতে ফুল,ফল উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় মূলত শীতকালেই এর চাষ করা হয় । অক্টোবর – নভেম্বর মাস বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। ঝাড় শিম এর জীবনকাল সাধারণত ৫০-৫৫ দিন । তাই একই মৌসুমে একাধিকবার চাষ করা সম্ভব ।
রোদ-আলো পূর্ণ জায়গা ঝাড় শিম চাষ এর জন্য উপযুক্ত। তবে হালকা ছায়াযুক্ত স্থানেও ঝাড় শিম হবে । তাই, যাদের বারান্দায় ৩-৪ ঘন্টা রোদ আসে তারাও ঝাড় শিম করতে পারবেন।
ঝাড় শিম এর চারা তৈরি:
বীজ থেকে চারা তৈরি করতে হয় । এক্ষেত্রে সরাসরি মূল টবে/পাত্রে বীজ বপন করে চারা করা যাবে বা অন্য কোন পাত্রে , সিডলিং ট্রে, সিডলিং ব্যাগে চারা করে পরে মূল টবে স্থানান্তর করতে হবে ।
শিম বীজ থেকে সহজেই চারা করা যায় । প্রথমে বীজ ৩-৪ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে । তারপর মাটিতে একটু গর্ত করে বীজ দিয়ে আবার মাটি দিয়ে বীজ ঢেকে দিতে হবে । তারপর পরিমাণ মত পানি দিয়ে মাটি ভিজিয়ে দিতে হবে । ২-৩ দিন এর মধ্যে বীজ জার্মিনেট হবে ও চারা বের হবে ।
আবার বীজ প্রথমে টিস্যু পেপার এর মাধ্যমে জার্মিনেট করে নিয়ে পরে মাটিতে বুনে দিয়েও চারা করা যাবে ।
টব/পাত্র নির্বাচন :
ঝাড় শিম চাষ এর জন্য বড় মাপের কোন টবের প্রয়োজন নেই। ৫ লিটার বোতল বা সমপরিমাণ টবে একটি ঝাড় শিম গাছ ভালো ভাবে হতে পারবে ।
১০-১২ ইঞ্চি টব বা ৭-৯ লিটার আয়তনের পাত্র/গ্রো ব্যাগে দুইটি গাছ রোপণ করা যাবে ।
আর বেডে রোপণ করলে প্রতি এক বর্গ ফুট জায়গায় দুইটি গাছ রোপণ করতে হবে।
টবের জন্য মাটি প্রস্তুত প্রণালী :
(Note: ১ টেবিল চামচ= ১০-১২ গ্রাম ; ১ চা চামচ= ৪ গ্রাম ; ১ টেবিল চামচ= ৩ চা চামচ ; ১ লিটার মাটি = ১.৫ কেজি)
ঝাড় শিম যেহেতু একটি ফলদ্বায়ী সবজি (fruiting vegetables) তাই এর প্রচুর খাদ্যের প্রয়োজন পরে । এজন্য মাটি তৈরিতে যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টি উপাদান দিতে হবে ।
টবের জন্য মাটি তৈরিতে –
১. দোআঁশ মাটি ৫০% , গোবর কম্পোস্ট ৩০% আর ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার করলে দোআঁশ মাটি ৬০% , ভার্মি কম্পোস্ট ২০% আর বাকি ২০% এর জন্য কোকোপিট ১০% আর নদীর লাল বালু ১০% হারে মেশাতে হবে । নদীর বালু না থাকলে কোকোপিট ব্যবহার করতে হবে ২০% । তবে কোকোপিট ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা নেই , হাতের কাছে থাকলে ব্যবহার করবেন।
২. রাসায়নিক সার- মাটি তৈরির সময় প্রত্যেক ৫ লিটার পাত্রের সমান মাটিতে ১ চা চামচ টিএসপি (TSP) বা ডিএপি (DAP) সার + হাফ চা চামচ এমওপি (MOP) সার মেশাতে হবে । আপনি যদি সম্পূর্ণ জৈব উপায়ে চাষ করতে চান তাহলে রাসায়নিক সার ব্যবহারের দরকার নেই । এতে যদিও ফলন কম হবে।
৩. এভাবে মাটি প্রস্তুত করে ১০-১৫ দিন রেখে দিতে হবে । তারপর গাছ রোপণ করতে হবে।
গাছ রোপণ পরবর্তী সার ব্যবস্থাপনা:
ঝাড় শিম চাষ এর জন্য গাছ রোপণ করার পর আরও দুই বার সার প্রয়োগের প্রয়োজন পরে। এতে সবোর্চ্চ ফলন নিশ্চিত হয় ( পরীক্ষিত) ।
১. চারা রোপণ এর ১৫ দিন পর ৫ লিটার আয়তনের টবের সমপরিমাণ মাটির জন্য হাফ চা চামচ ইউরিয়া সার মাটিতে ছিটিয়ে দিয়ে নিড়ানি দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগের পরের দিন পানি সেচ দিতে হবে।
২. একই পরিমাণ ইউরিয়া ও হাফ চা চামচ পটাস সার চারা রোপণ এর ৩০-৩৫ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে।
এই দুই বারের পর আর রাসায়নিক সার প্রয়োগ এর প্রয়োজন পরে না। এতেই সবোর্চ্চ ফলন নিশ্চিত হয় । তবে, পরবর্তীতে কোন সারের অভাব জনিত লক্ষণ দেখা দিলে সে সার প্রয়োজন মতো ব্যবহার করতে হবে।
জৈব সার –
চারা রোপণ এর পর প্রতি ১৫ দিন পর পর ৫ লিটার বোতল বা সমপরিমাণ টবের মাটির জন্য এক মুঠো করে ভার্মি কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। টবের উপরের মাটি আলগা করে জৈব সার মাটিতে ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে ।
তবে রাসায়নিক সার প্রয়োগ এর সময়কালে জৈব সার প্রয়োগ না করে পরবর্তীতে ১০-১৫ দিন অন্তর অন্তর জৈব সার ব্যবহার করলে ভালো হয়।
শিম উত্তোলন/হার্ভেস্ট :
সাধারণত চারা রোপণ এর ৩৫-৪০ দিন এর মধ্যে ঝাড় শিমে ফুল চলে আসে । আর ৮-১০ দিনে ফল খাওয়ার উপযোগী হয়ে যায় । প্রতি থোকায় ২-৭ টি শিম ধরে ও গড় প্রতি ফলের ওজন ৫-৬ গ্রাম , লম্বায় ৪-৬ ইঞ্চি ।
ফলের জন্য শিম বেশি পরিপক্ক হওয়ার আগেই উত্তোলন করতে হবে। আর বীজ হিসেবে খাওয়ার জন্য শিম ভালো ভাবে পরিপক্ক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
ঝাড় শিম এর রোগ-বালাই ও সমাধান:
শিম সহ অন্যান্য সকল শাক-সবজি অল্প করে ছাদে/টবে চাষ করলে পোকা-মাকড় এর উৎপাত ব্যাপক হারে চোখে পরে । ঝাড় শিম চাষ এ সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে জাব পোকা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা।
এখানে কিছু প্রধান রোগ/সমস্যা ও তার সমাধান উল্লেখ করা হয়েছে । এর বাইরে অন্য কোন সমস্যা আপনার গাছে পরিলক্ষিত হলে কমেন্ট করে জানাবেন, সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করব ।
১. ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ:
এই পোকা পট বোরার নামে পরিচিত। যা ফল ও বীজ ছিদ্র করে খায় এবং শিম এর ফুলের কুঁড়িও খেয়ে ফেলে।
প্রতিরোধ ব্যবস্থা:
পোকা আক্রান্ত ফল নিয়মিত বাছাই করে বাগান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে।
হলুদ আঠালো ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে।
জৈব বালাইনাশক প্রয়োগ : নিম তেল বা অনুমোদিত জৈব কীটনাশক ব্যবহার করলে এই পোকা কিছুটা দমন হয় । এর জন্য প্রত্যেক সপ্তাহে একবার করে নিম তেল স্প্রে করতে হবে ।
তবে আক্রমণ প্রকট হলে জৈব কীটনাশক এ কাজ নাও হতে পারে ।
রাসায়নিক কীটনাশক: অধিক আক্রমণ হলে তখন রাসায়নিক কীটনাশক ব্যতিত ফসল রক্ষা করা সম্ভব হয় না ।
এজন্য সাইপারমেথ্রিন বা এমামেকটিন বেনজোয়েট জাতীয় কীটনাশক ১২-১৫ দিন পর পর দুই-তিন বার প্রয়োগ করলে পট বোরার সম্পূর্ণ দমন হয় ।
২. সাদা মাছি ও জাব পোকার আক্রমণ:
এই দুই পোকা ভাইরাস এর জীবাণু বহন করে । তাই এসব পোকা গাছে দেখা মাত্র নির্মূল করতে হবে। কারণ একবার ভাইরাস আক্রমণ করলে তা আর প্রতিকার করা যায় না।
সাদা মাছি: পাতার নিচের দিকে হলুদাভ সাদা রংয়ের ছোট ছোট পোকা দেখা দেয় যেখানে নিম্ফ ও পূর্ণ বয়স্ক পোকা একসাথে অবস্থান করে ।
পাতার রস চুষে খাওয়ার ফলে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে।
জাব পোকা: পূর্নাঙ্গ পোকা এবং বাচ্চা উভয়ই দেখতে ছোট আকৃতির, বাদামি অথবা বাদামি কালো রঙের। এরা দলবদ্ধ ভাবে থাকে। এগুলো খালি চোখে দেখা যায় । পাতার উল্টা পাশে পোকার উপস্থিতি বেশি থাকে।
পাতা থেকে রস চুষে খায় এবং কান্ডেও আক্রমণ করে । আক্রমণের এক পর্যায়ে পাতা -কান্ড হলুদ হয়ে শুকিয়ে যায়।
দমন ব্যবস্থা: এই পোকা গুলো দমন করতে নিম তেল নিয়মিত স্প্রে করতে হবে। সাবান-পানি ব্যবহারেও কিছুটা দমন হয় ।
তবে আক্রমণ অধিক হলে এসব উপায়ে দমন সম্ভব হয় না , তখন রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগ এর প্রয়োজন পরে ।
রাসায়নিক কীটনাশক – ইমিডাক্লোপ্রিড , সাইপারমেথ্রিন, থাইম্যাথক্সাম, ডায়মেথোয়েট এজাতীয় কীটনাশক এর যেকোন একটি প্রয়োগে জাব পোকা,সাদা মাছি ও মিলিবাগও দমন হবে ।
৩. ভাইরাস গঠিত রোগ :
ভাইরাস দ্বারা শিম গাছে কিছু রোগ হয়ে থাকে যা মূলত শোষক জাতীয় পোকা দ্বারা ছড়িয়ে থাকে।এসব রোগ হয়ে গেলে পরে আর প্রতিকার করা যায় না । কারণ ভাইরাস এর কোন প্রতিষেধক নেই ।
৩.১ লিফ কার্ল রোগ:
এরোগে গাছের পাতায় ঢেউ এর মতো ভাঁজের সৃষ্টি হয় । এতে পাতা পুরু ও মচমচে হয়ে যায় । গাছ খর্বাকৃতির হয়ে যায় , অধিক শাখা প্রশাখা বের হয় । ফলস্বরূপ ফুল -ফল ধারণ ক্ষমতা দারুন ভাবে হ্রাস পায়।
৩.২ ঝাড়শিমের মোজাইক রোগ:
এ রোগে পাতায় হলুদ ও গাড়ো সবুজ রং এর ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায়। জাব পোকা এই ভাইরাসের বাহক হিসেবে কাজ করে । এই রোগে ফলন কমে যায় ।
দমন ব্যবস্থা: ভাইরাসের কোন প্রতিষেধক না থাকায় রোগ হওয়ার আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে । গাছে জাব পোকা, সাদা মাছি এজাতীয় কোন শোষক পোকা থাকলে দমন করতে হবে । এর জন্য নিম তেল নিয়মিত স্প্রে করতে হবে ।
আর রাসায়নিক কীটনাশক সাইপারমেথ্রিন বা ইমিডাক্লোপিড গ্রুপের কীটনাশক প্রয়োগে এসব পোকা দমন হবে ।
৪. ঢলে পড়া রোগ:
ছত্রাকজনিত একটি রোগ হলো ব্যাক্টেরিয়াল উইল্ট বা ঢলে পড়া । ঝাড় শিম চাষ এর ক্ষেত্রে এটি একটি মারাত্মক রোগ যার কারণে গাছ ঢলে পড়ে মরে যায় ।এ রোগে গাছ আস্তে আস্তে নেতিয়ে বা ঢলে পড়ে এবং পরবর্তীতে মারা যায় ।
দমন ব্যবস্থা – এ রোগের জন্য আক্রমণ হওয়ার আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে। গাছ ঢলে পড়লে সেই গাছ আর বাঁচানো সম্ভব হয় না তবে আক্রমণ এর প্রথম পর্যারে ছত্রাকনাশক (কার্বন্ডাজিম+ম্যানকোজেব) স্প্রে করলে কাজ হতে পারে ।
প্রতিরোধ ব্যবস্থা – আক্রান্ত গাছ বাগান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে
বীজ বা চারা রোপণ এর আগে চারা শোধন করে নিতে হবে । শোধন করতে এক লিটার পানিতে ১ চা চামচ (কার্বন্ডাজিম) জাতীয় ছত্রাকনাশক মিশিয়ে সেই পানিতে বীজ বা চারার গোড়া ১৫-২০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে ।
চারা রোপণ এর ৩০ দিন পর (কার্বন্ডাজিম+ম্যানকোজেব) জাতীয় ছত্রাকনাশক ভালো করে গাছে স্প্রে করে দিতে হবে । এক লিটার পানিতে এক চা চামচ ছত্রাকনাশক পাউডার মেশাতে হবে ।
