ডিমের খোসার প্রধান উপাদান ক্যালসিয়াম, এজন্য এর নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে । উদ্ভিদের খাদ্য উপাদানের একটি হলো ক্যালসিয়াম , তাই ডিমের খোসা উদ্ভিদের জন্য ব্যবহার করা হয় । কিন্তু, বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন – ফেসবুক, ইউটিউবে ডিমের খোসার বাগান/উদ্ভিদে নানাবিধ ব্যবহার প্রচার করছে । এসব ব্যবহারের অধিকাংশই ভিত্তিহীন , উপকারবিহীন । এসব প্রচলিত ব্যবহার/বিশ্বাস কত টুকু যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সহকারে আলোচনা করা হয়েছে।
সূচিপত্র –
- ডিমের খোসার উপাদান
- গাছ ডিমের খোসার ক্যালসিয়াম গ্রহণ করতে পারে ?
- ডিমের খোসা ডিকম্পোস্ট হতে সময়
- ডিমের খোসার কিছু প্রচলিত ব্যবহার ও বাস্তবতা
1. গাছের ক্যালসিয়াম এর অভাব পূরণ করে
2. গাছের মাইক্রোনিয়ট্রিয়েন্ট/অণুখাদ্য সরবরাহ
করে
3. টমেটোর ব্লোজম ইন্ড রট (Blossom End Rot)
রোগ দমন করে
4. শামুক, পোকা-মাকড় দূর করে
5. কম্পোস্ট তৈরিতে ডিমের খোসা ব্যবহার
6. জৈব কীটনাশক হিসেবে কাজ করে
7. চারা উৎপাদনের পট হিসেবে ব্যবহার
ডিমের খোসা ব্যবহার করা উচিত না অনুচিত?
ডিমের খোসার উপাদান:
প্রধান উপাদান ক্যালসিয়াম। এতে ক্যালসিয়াম থাকে ৩৪% , ম্যাগনেসিয়াম ০.৩%, ফসফরাস ০.০৪% , পটাসিয়াম ০.০৩% । এছাড়াও এতে রয়েছে ৫% জৈব উপাদান ।
খোসার দুইটি অংশ বাইরের শক্ত অংশ আর ভেতরের পাতলা সাদা চামড়ার মতো অংশ । জৈব অংশ ভেতরের চামড়ায় থাকে যা মূলত প্রোটিন ।
গাছ ডিমের খোসার ক্যালসিয়াম গ্রহণ করতে পারে ?
ডিমের খোসায় নিঃসন্দেহে অধিক পরিমাণে ক্যালসিয়াম রয়েছে যা ক্যালসিয়াম কার্বনেট রূপে থাকে। উদ্ভিদ এই ক্যালসিয়াম কার্বনেট সরাসরি গ্রহণ করতে পারে না । খোসা মাটিতে থেকে বা অন্য কোন ভাবে ডিকম্পোস্ট হয়ে উদ্ভিদের গ্রহণ উপযোগি ক্যালসিয়াম এর উপাদানে পরিণত হয় । অর্থাৎ, খোসা ডিকম্পোস্ট না হওয়া পর্যন্ত উদ্ভিদ কোন ক্যালসিয়াম গ্রহণ করতে পারে না ।
ডিমের খোসা ডিকম্পোস্ট হতে সময় :
খোসা দীর্ঘদিন পর্যন্ত মাটিতে অক্ষত অবস্থায় থেকে যায় । এমনকি অতি ক্ষুদ্র চূর্ণ করে দিলেও মাটিতে সামান্য ডিকম্পোস্ট হয় । ২-৩ বছরেও খোসা পুরোপুরি ডিকম্পোস্ট হয় না ।
মাটি অতিরিক্ত এসিডিক হলে ডিকম্পোস্ট কিছুটা তাড়াতাড়ি হয় । এছাড়াও পানিতে খোসা ডুবিয়ে রাখলে বা গরম পানিতে সিদ্ধ করলেও ডিকম্পোস্ট হয় না ।
ডিমের খোসার কিছু প্রচলিত ব্যবহার ও বাস্তবতা:
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উদ্ভিদে ডিমের খোসার নানাবিধ উপকারী গুণাগুণ প্রচার করা হয় । এসব ব্যবহারের বেশিরভাগই কোন পরীক্ষিত প্রমাণ বিহীন ও যুক্তি সম্পন্ন নয় । আবার উদ্ভিদ কর্তৃক ক্যালসিয়াম এর গ্রহণ মাত্রা কম । মাটিতে ক্যালসিয়াম এর অতি স্বল্প উপস্থিতেও উদ্ভিদের প্রয়োজন মিটে যায় ।
১. গাছের ক্যালসিয়াম এর অভাব পূরণ করে :
প্রচলিত বিশ্বাস – গাছে ক্যালসিয়াম এর অভাব হলে মাটিতে খোসা চূর্ণ করে অথবা খোসা পানিতে চুবিয়ে রেখে সেই পানি দিলে ক্যালসিয়াম এর অভাব পূরণ হয় ।
বাস্তবতা: গাছে ক্যালসিয়াম এর অভাব পূরণে ডিমের খোসা ব্যবহার যুক্তিযুক্ত নয় । কারণ খোসা ডিকম্পোস্ট হতে অনেক সময় লেগে যায় । আবার ডিমের খোসা পানিতেও দ্রবণীয় হয় না তাই খোসা পানিতে চুবিয়ে রেখে দিলেও সেই পানিতে ক্যালসিয়াম রিলিজ হবে না ।
অর্থাৎ, গাছে ক্যালসিয়াম এর অভাবজনিত লক্ষণ দেখা দিলে খোসা ব্যবহার না করে বরং ক্যালসিয়াম জাতীয় সার জিপসাম ব্যবহার করা উচিত ।
২. গাছের মাইক্রোনিয়ট্রিয়েন্ট/অণুখাদ্য সরবরাহ করে:
প্রচলিত বিশ্বাস – ডিমের খোসা উদ্ভিদের অণুখাদ্যের উৎস হিসেবে কাজ করে । মাটিতে খোসা চূর্ণ প্রয়োগ করলে গাছ অণুখাদ্য পায় ।
বাস্তবতা: ডিমের খোসার প্রধান উপাদান ক্যালসিয়াম আর খুবই সামান্য পরিমাণে বিভিন্ন অণুখাদ্য থাকে । কিন্তু এই অণুখাদ্য তখনই গাছের কাজে আসবে যখন খোসা ডিকম্পোস্ট হবে । আগেই আলোচনা করা হয়েছে খোসা ডিকম্পোস্ট হতে অনেক সময় লেগে যায় । যদি খোসা দীর্ঘদিন মাটিতে থাকে তাহলে একসময় ডিকম্পোস্ট হয়ে অণুখাদ্য সরবরাহ করবে তবে এর পরিমাণ অতি সামান্য যা মাটির অণুখাদ্যের তারতম্যে তেমন প্রভাব ফেলবে না ।
অর্থাৎ, ডিমের খোসা গাছের অণুখাদ্যের জন্য কোন ভালো উৎস নয় । বরং মাটিতে নিয়মিত জৈব সার প্রয়োগ করলে গাছ পর্যাপ্ত অণুখাদ্য পাবে ।
৩. টমেটোর ব্লোজম ইন্ড রট (Blossom End Rot) রোগ দমন করে:
প্রচলিত বিশ্বাস – ডিমের খোসা চূর্ণ মাটিতে বা পানিতে খোসা ডুবিয়ে রেখে সেই পানি প্রয়োগ করলে টমেটোর ব্লোজম ইন্ড রট রোগ ভালো হয় ।
বাস্তবতা: প্রথমে বুঝতে হবে ব্লোজম ইন্ড রট কেনো হয় । টমেটোর ব্লোজম ইন্ড রট রোগ গাছে ক্যালসিয়ামের অভাবে হয় । অর্থাৎ এর মানে এই নয় যে মাটিতে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি রয়েছে । মাটিতে পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম থাকার পরও গাছ গ্রহণ করতে না পারলে ব্লোজম ইন্ড রট রোগ হয় । তাই, ডিমের খোসা প্রয়োগে টমেটোর ব্লোজম ইন্ড রট রোগ প্রতিরোধের কোন প্রশ্নই আসে না ।
অর্থাৎ, ডিমের খোসা ব্লোজম ইন্ড রট রোগ দমন করতে পারে না । বরং নিয়মিত পরিমিত মাত্রায় পানি সেচের ব্যবস্থা করলে এই রোগ প্রতিরোধ সম্ভব । আবার, যে সব মাটিতে ক্যালসিয়াম ঘাটতি রয়েছে তাতে মাটি তৈরির সময় ক্যালসিয়াম এর উৎস হিসেবে ডলোচুন প্রয়োগ করতে হবে।
৪. শামুক, পোকা-মাকড় দূর করে :
প্রচলিত বিশ্বাস – খোসা চূর্ণ করে গাছের গোড়ার চারপাশে দিয়ে দিলে শামুক সহ কিছু পোকা-মাকড় গাছ থেকে দূরে থাকে ।
বাস্তবতা: খোসা চূর্ণ শামুক জাতীয় প্রাণি থেকে গাছ কে রক্ষা করতে পারে না । ডিমের খোসা এসবের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করতে পারে না । ছবিতে ক্যাকটাস এর ধারালো কাঁটার উপর শামুক এর অবস্থান দেখা যাচ্ছে।
অর্থাৎ, শামুক জাতীয় প্রাণি দমনে খোসা চূর্ণ ব্যবহার একটি অকার্যকর পদ্ধতি । বরং ডিমের খোসা ব্যবহারে গাছের চারপাশে অনেক সময় পিঁপড়ার আনাগোণা বৃদ্ধি করে ।
৫. কম্পোস্ট তৈরিতে ডিমের খোসা ব্যবহার :
খোসা কম্পোস্ট তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে । তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে ডিমের খোসা ডিকম্পোস্ট হতে অনেক সময় নেয় । এজন্য খোসা ব্যবহার করতে চাইলে অতি ক্ষুদ্র চূর্ণ করে নিতে হবে । এতে ডিকম্পোস্ট তাড়াতাড়ি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ।
তবে, কম্পোস্টে ডিমের খোসা ব্যবহার না করাই ভালো । যেহেতু কম্পোস্টে অন্যান্য আরও জৈব উপাদান থাকবে সেগুলো থেকে অল্প সময়ে ক্যালসিয়াম পাওয়া যাবে ।
৬. জৈব কীটনাশক হিসেবে কাজ করে :
প্রচলিত বিশ্বাস – খোসা পানিতে সিদ্ধ করে সেই পানি বা খোসা চূর্ণ করে পানির সাথে মিশিয়ে মাটিতে প্রয়োগ করলে বিটল পোকা সহ কিছু পোকা, পোকার লার্ভা ধ্বংস হয় ।
বাস্তবতা: ডিমের খোসার পানি ব্যবহারে পোকা দমন হয় এমন পরীক্ষিত কোন প্রমাণ নেই ।
৭. চারা উৎপাদনের পট হিসেবে ব্যবহার:
ডিমের খোসাকে চারা উৎপাদনের পট (Saplings starter pot) হিসেবে ব্যবহার করা যায় । তবে খোসা যেহেতু অনেক অল্প পরিমাণ মাটি ধরে তাই খুব একটা ভালো পট বলা যাবে না । ছোট সাইজের চারা উৎপাদনের জন্য খোসা ব্যবহার করা যাবে ।
চারা রোপণের উপযোগী হলে অবশ্যই খোসা বাদ দিয়ে মাটিসহ চারা রোপণ করতে হবে ।
অর্থাৎ, ডিমের খোসায় চারা তৈরি করা গেলেও খুব একটা উপযোগী নয় ।
পরিশেষে, ডিমের খোসা ব্যবহার করা উচিত না অনুচিত?
উত্তর – খোসার তিন ভাগের এক ভাগ হলো ক্যালসিয়াম । অর্থাৎ ক্যালসিয়াম এর ভালো একটি উৎস ডিমের খোসা । কিন্তু, সমস্যা হলো খোসা সহজে ডিকম্পোস্ট হয় না । তাই, দ্রুত সময়ে ক্যালসিয়াম পাওয়ার জন্য খোসা ব্যবহার মোটেও যুক্তিযুক্ত নয় । আবার প্রয়োগ করার ২-৩ বছর পর ক্যালসিয়াম পাওয়া গেলেও তার পরিমাণ অত্যন্ত কম, মানে ধীরে ধীরে রিলিজ হয় একসাথে সম্পূর্ণ টা পাওয়া যায় না ।
তাই, ডিমের খোসা চূর্ণ ব্যবহার না করাই উত্তম ।
বরং, ক্যালসিয়াম এর চাহিদা পূরণে নিয়মিত জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে । আর মাটিতে ক্যালসিয়াম এর ঘাটতি থাকলে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ জিপসাম সার ব্যবহার করতে হবে ।
রেফারেন্স – Eggshells – How Not To Use Them In The Garden
