১০০% কার্যকরীভাবে বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা দমন

বেগুন চাষের প্রধান একটি সমস্যা হলো ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা, যা বেগুনের ফলন শতভাগ নষ্ট করে দিতেও সক্ষম । শীতের কয়েক মাস বাদ দিয়ে বাকি প্রায় সারা বছরই এই পোকার ননস্টপ আক্রমণ চলতে থাকে । তবে কিছু কার্যক্রমের মাধ্যমে পোকা দমন করা যায়,এর মধ্যে ছাদ-বারান্দা বাগানীদের জন্য ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতি অত্যন্ত সহজ ।

সূচীপত্র –

  • ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার জীবনচক্র
  • ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার লক্ষণ
  • জৈবিক প্রক্রিয়ায় পোকা দমন
  • রাসায়নিক কীটনাশক দ্বারা পোকা দমন
  • প্রতিরোধ ব্যবস্থা

ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার জীবনচক্রঃ

জীবনচক্রটি খেয়াল করুন। এখানে মোট চারটি অবস্থা রয়েছে, এর যেকোন একটি অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে পোকা দমন সহজ হয়ে যায়। 

১. ডিম- পূর্ণ বয়স্ক পোকা পাতা-ডগার ছালের মধ্যে কিছুটা ছিদ্র করে ডিম পারে । অর্থাৎ খালি চোখে ডিম খোঁজে পাওয়া কঠিন। জৈব বা রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগে ডিম নষ্ট হয়ে যায়। ২. লার্ভা- এই দশাটি কৃষকের কাছে দৃষ্টি গোচর হয় এবং এটিই মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। লার্ভা যেহেতু বেগুন বা ডগার ভিতরে থাকে তাই , এটি দমন করা কঠিন হয়ে পরে । এজন্য লার্ভা দমনে দরকার স্থানীয়ভাবে অনুপ্রবেশ ক্ষমতা অথবা প্রবাহমান ক্ষমতা সম্পন্ন কীটনাশক। ৩. পিউপা- এই অবস্থা শুকনো পাতা, গাছের গোড়ার মাটি,আগাছার মধ্যে থাকে। তাই এটি ধ্বংস করতে ক্ষেত সব সময় আগাছা মুক্ত, শুকনো ডালপালা মুক্ত রাখতে হবে এবং মাঝে মাঝে গোড়ার মাটি নিড়ানি দিয়ে আলগা করে দিতে হবে ।৪. পূর্ণ বয়স্ক পোকা বা মথ- এই অবস্থা ধ্বংস করার জন্য জৈব প্রক্রিয়া- ফেরোমন ফাঁদ স্থাপন করতে হবে। বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার জন্য আলাদা ফেরোমন ফাঁদ পাওয়া যায় বাজারে।

এই পোকা ইংরেজিতে Shoot and fruit borer, বাংলায় ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা,ফল ছিদ্রকারী পোকা,নলি পোকা, ইত্যাদি নামে পরিচিত। এরকম একই রকম বৈশিষ্ট্যের পোকা শিম জাতীয় সবজিতেও দেখা যায়, যা পড বোরার (bean pod borer) নামে পরিচিত।
বেগুন গাছে এ পোকার জীবনকাল শুরু হয় পূর্ণবয়স্ক পোকার ডিম পাড়ার মাধ্যমে। পূর্ণবয়স্ক মথ পোকা রাতের বেলা সক্রিয় হয় এবং শেষরাতের দিকে গাছের কচি ডগা,পাতায়,কান্ডের উপর,ফুলের কুঁড়ি,ফলের উপরে সাদা রং এর ডিম পাড়ে। একটি মথ সারা জীবনে ১৫০-৩৫০ টি পর্যন্ত ডিম দেয়। ৩-৫ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে কীড়া বের , যা মূলত বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা হিসেবে পরিচিত এবং এই কীড়া দাঁড়াই সমস্ত ক্ষতি সাধন হয়ে থাকে। কীড়া প্রথম অবস্থায় গাছে ফল না থাকলে কচি ডগায় আক্রমণ করে পরবর্তীতে ফুল,কচি ফলে আক্রমণ করে। কীড়া ডগা বা ফল ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে ভেতরের শাঁস খেতে থাকে। কীড়া বা লার্ভা ১২-১৫ দিন পর ডগা বা ফল থেকে বের হয়ে আসে এবং শুকনো পাতায়, ঝরে পরা পাতায় বা মাটির কাছাকাছি পাতায় পুত্তুলি তৈরি করে।  ৬-৮ দিন পর পুত্তুলি থেকে পূর্ণাঙ্গ মথ বের হয়ে আসে । মথ ২-৫ দিন বেঁচে থাকা অবস্থায় প্রজনন সম্পূর্ণ করে ডিম পাড়ে। এভাবে ২১-৪৩ দিনের মতো সময়ে পোকা তার জীবনচক্র সম্পূর্ণ করে থাকে।

ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার লক্ষণঃ

সাধারণত শীতের সময় এই পোকার আক্রমণ কম হয় আর শীতের পরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় সাথে সাথে পোকার আক্রমণ প্রকট হতে থাকে।
চারা রোপণ এর ১-১.৫ মাসের মধ্যে পোকার আক্রমণ দেখা যায়। প্রথম অবস্থায় কচি ডগা ছিদ্র করে ভেতরের অংশ খেয়ে ফেলে , ফলে ডাল নেতিয়ে পরে। নেতিয়ে পরা কচি ডাল দেখে এই পোকা সহজেই নির্ণয় করা যায়। পরবর্তীতে ফল আসা শুরু হলে কচি ফল ছিদ্র করে ভেতরে প্রবেশ করে আঠালো মল দ্বারা ছিদ্রের পথ বন্ধ করে দেয় এবং জীবনকাল পূর্ণ করে আবার বেগুন ছিদ্র করে বাইরে বের হয়ে আসে। তখন বেগুনের গায়ে কালো মল যুক্ত ছিদ্র দেখা যায়।

জৈবিক প্রক্রিয়ায় পোকা দমনঃ

বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনের বিভিন্ন জৈবিক পদ্ধতি রয়েছে। এসব প্রক্রিয়ায় পোকা সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা না গেলেও অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আর ছাদ বাগানের জন্য বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে জৈব পদ্ধতিই উত্তম । নিচে কিছু প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হলো-

১. বিটি (BT) বেগুন চাষ:

BT- Bacillus thuringensis (বেসিলাস থুরেনজেনসিস) ,জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে উদ্ভাবিত জাত,যা ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধী সক্ষম জাত। বিটি বেগুন প্রাকৃতিক ভাবেই পোকা প্রতিরোধ করতে পারে, আলাদা করে কোন কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয় না। বাংলাদেশে বিটি বেগুনের চারটি জাত রয়েছে –

  • বারি বিটি বেগুন -১ (গোলাপি রঙের লম্বা)
  • বারি বিটি বেগুন -২ (বেগুনি রঙের লম্বা)
  • বারি বিটি বেগুন -৩ (গাঢ় বেগুনি রঙের গোল)
  • বারি বিটি বেগুন -৪ (সবুজ রঙের গোল)

২. ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার:

ফেরোমন হচ্ছে এক ধরনের প্রাকৃতিক রাসায়নিক পদার্থ, যা স্ত্রী পোকা কর্তৃক নিঃসরণ করা হয় পুরুষ পোকাকে প্রজনন কাজে আকৃষ্ট করার জন্য। এই ফেরোমন কে কৃত্রিম ভাবে তৈরি করে পোকার জন্য ফাঁদ তৈরি করা হয়,এতে পুরুষ পোকা গুলো ফাঁদে আটকে মারা যায়। ফলে স্ত্রী পোকা প্রজনন কাজ সম্পূর্ণ করতে পারে না, এভাবে পোকার আক্রমণ দমন হয় । এটি একটি পরিবেশ বান্ধব জৈব প্রক্রিয়া ।
বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার জন্য নির্দিষ্ট ফেরোমোন ফাঁদ পাওয়া যায়। আপনার স্থানীয় বাজারের কৃষি পণ্যের দোকানে খোঁজ করলে ফাঁদ পেয়ে যাবেন। মাঠ কৃষিতে চাষাবাদের ক্ষেত্রে প্রতি শতাংশে একটি করে ফাঁদ দরকার পরে , সেমতে ছাদ বাগানের ১০-৫০ টি গাছের জন্য একটি ফাঁদই যথেষ্ট।

৩. জৈব বালাইনাশক প্রয়োগ:

বাইকাও কীটনাশক বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা দমন করতে পারে। এটি কীটনাশক এর পাশাপাশি অনুখাদ্য হিসেবেও কাজ করে। নিম,থুজা, নয়নতারা সহ বিভিন্ন গাছের নির্যাস থেকে এটি তৈরি করা হয়, যা পরিবেশ বান্ধব ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিহীন। প্রতি লিটার জলের সাথে ১ মি:লি: বাইকাও মিশিয়ে গাছের পাতা ও কান্ডে ভালো করে স্প্রে করতে হবে।
নিম তেল বা নিম বীজ এর নির্যাস থেকে তৈরি কীটনাশক যেমন-নিমবিসিডিন ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা ও পোকার ডিম ধ্বংস করতে সক্ষম। এক্ষেত্রে নিয়মিত নিম তেল স্প্রে করে যেতে হবে।

৪. ফল ব্যাগিং করা:

ফুল ফুটার পর বেগুন সেট হওয়ার সাথে সাথে অর্থাৎ- ফুল বুজে যাওয়ার সাথে সাথে ব্যাগিং করতে হবে। ফলের বোঁটার দিক ভালো করে আটকিয়ে দিতে হবে । চীন থেকে আমদানি করা সাদা ও বাদামি রং এর ফ্রুট ব্যাগ ব্যবহার করে ব্যাগিং করলে বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা শতভাগ দমন করা যায় ,আবার এতে উৎপাদনও বেশী হয় । এছাড়াও স্থানীয় বাজারের সহজলভ্য পলিথিন ব্যাগ, যা দিয়ে পেয়ারা ব্যাগিং করা হয় সেটা ব্যবহার করেও বেগুন ব্যাগিং করা যাবে । এতেও পোকা দমন হবে, কোন রকম কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে না।
অর্থাৎ- ব্যাগিং কার্যকরী পরিবেশ বান্ধব একটি প্রক্রিয়া, যা ছাদ বাগানের জন্য বিষণ ভাবে উপযোগী।

রাসায়নিক কীটনাশক দ্বারা পোকা দমনঃ

কীটনাশক এর মাধ্যমে পোকা দমনের জন্য দুই ধরনের কীটনাশক প্রয়োগ প্রয়োজন,তা হলো স্পর্শ ক্রিয়া সম্পন্ন ও অর্ন্তবাহী গুণ সম্পন্ন কীটনাশক। তাহলে পোকার ডিম, বাইরে অবস্থান করা পোকা ও ফল বা ডগার ভেতরের পোকাও ধ্বংস হবে।
১. ভলিয়াম ফ্লাক্সি
(থায়ামিথক্সাম+ক্লোথায়ারানিলিপ্রল) 
ভালো কাজ করে। এটি বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা, টমেটোর ফল ছিদ্রকারী পোকা ও শিমের ফল ছিদ্রকারী পোকার জন্য অনুমোদিত কীটনাশক।

ভারতের বাগানিরা Rocket(Profenofos + Cypermethrin) ব্যবহার করবেন।

২. সাইপারমেথ্রিন, কারটাপ, এমামেকটিন বেনজোয়েট, ইত্যাদি ব্যবহার করেও পোকা দমন করা যাবে।

( বিষ প্রয়োগ মাত্রা,মিশ্রণ তৈরির জন্য কীটনাশকের প্যাকেট বা বোতলের গায়ে দেওয়া নির্দেশনা অনুসরণ করবেন।
আর বিষ প্রয়োগের ১২-১৫ দিন এর মধ্যে গাছ থেকে কোন বেগুন সংগ্রহ করবেন না। )

প্রতিরোধ ব্যবস্থাঃ

১. শীতকালীন আগাম জাতের বেগুন চাষ করতে হবে। এজন্য অক্টোবর মাসের মধ্যে চারা রোপণ শেষ করতে পারলে পুরো শীত মৌসুম জুড়ে পোকা বিহীন বেগুন পাওয়া যাবে। কারণ শীতের সময় ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা আক্রমণ করে না।
২. শীতের পরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় সাথে সাথে সর্তক থাকতে থাকে । কারণ উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় পোকার ব্যাপক বিস্তার ঘটে। এসময় নিয়মিত নিম তেল স্প্রে করা যেতে পারে।
৩. শুকনো পাতা, ঝরে পরা পাতা, হলুদ হয়ে যাওয়া নিয়মিত পরিষ্কার করে বাগান থেকে দূরে সরিয়ে ফেলতে হবে।
৪. আক্রান্ত ডগা বা ফল নজরে আসা মাত্রই বাগান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। আর দ্রুত দমন ব্যবস্থা নিতে হবে।
৫. উন্নত জাতের ও রোগমুক্ত বীজ থেকে চারা করতে হবে। সব সময় আগাম চাষ করার চেষ্টা করতে হবে।
৬. সম্ভব হলে নাইলনের এন্টি ইনসেক্ট পেষ্ট কন্ট্রোল জাল দিয়ে গাছ ঘিরে দিতে হবে। এতে পোকা গাছের গায়ে ডিম পাড়তে পারবে না ।

Leave a Reply