ফসলের ১২ টি উপকারী পোকা ও তাদের উপকারী কার্যক্রম

ক্ষতিকর পোকার আক্রমণে যেসব বাগানি অতিষ্ঠ তাদের জন্য সুখবর। কারণ, আজকে এমন কিছু পোকার সাথে পরিচয় করিয়ে দিব যারা ফসলের ক্ষতি না করে বরং উপকার করে ,যা ফসলের উপকারী পোকা হিসেবে পরিচিত। আর এসব পোকার সাহায্যে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলার মতো অর্থাৎ পোকা দিয়ে পোকা দমন করার একটি ব্যবস্থাপনা রয়েছে যাকে বলা হয় সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (IPM). 

সূচীপত্র – 

  • সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার জৈবিক পদ্ধতি
  • উল্লেখযোগ্য কিছু উপকারী পোকার পরিচয় ও সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনায় ভূমিকা

০১- লেডি বার্ড বিটল (Ladybird beetles)

০২- গ্রিনলেস উইং (Green lacewings)

০৩- ব্রাকোনিড বোলতা (Braconid wasps)

০৪- ট্রাইকোগ্রামা (Trichogramma)

০৫- কানকোটারী (Earwig)

০৬- প্রেইং ম্যানটিড (Praying Mantids)

০৭- ড্যামসেল ফ্লাই (Damselfly)

০৮- মিরিড বাগ (Mirid Bug)

০৯- পরভোজী মাকড় 

১০- সিরফিড মাছি (Syrphid Flies)

১১- ক্যারাবিড বিটল (Carabid Beetle)

১২- অ্যানথোকোরিড বাগ (Anthocorid Bugs)

সমন্বিত বালাই স্থাপনার জৈবিক পদ্ধতিঃ

প্রথমে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে কিছু সংক্ষিপ্ত তথ্য জেনে নেওয়া যাক – সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (Integrated Pest Management) বা সংক্ষেপে IPM বলতে, “পরিবেশকে দুষণমুক্ত রেখে প্রয়োজনে এক বা একাধিক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ বালাইকে অর্থনৈতিক ক্ষতি সীমার নিচে রাখাকে বুঝায়, যাতে করে পরিবেশ দূষণ না হয়। উপকারী(বন্ধু) পোকামাকড় সংরক্ষণ, বালাই সহনশীল জাত ও আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ব্যবহার এবং সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে বালাই নাশকের সঠিক ও যুক্তি সঙ্গত ব্যবহারকে নিশ্চিত করে।”

জৈবিক পদ্ধতি – সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার একটি পদ্ধতি হলো জৈবিক পদ্ধতি। মূলত এটিই সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মূলভিত্তি। আমাদের প্রকৃতিতেই বালাই নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের শুধু দরকার এসব ব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানো। এসব প্রাকৃতিক শত্রুর (ক্ষতিকর পোকার জন্য শত্রু কিন্তু ফসলের বন্ধু) কেউ পরভোজী, কেউ পরজীবী আবার কেউ বালাইয়ের দেহে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু হিসেবে কাজ করে। ফসলের মাঠে,ক্ষেতে,ফলবাগানে কোনো রাসায়নিক বালাইনাশক প্রয়োগ না করলে এসব উপকারী পোকার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ও প্রকৃতির নিয়মেই তারা বিভিন্নভাবে বালাই নিয়ন্ত্রণ করে। এতে পরিবেশের মধ্যে শত্রু মিত্রের ভারসাম্য বজায় থাকে তথা ফসলের মাঠে, সবজি ক্ষেতে , ফলবাগানের পরিবেশ ঠিক থাকে।

উল্লেখযোগ্য কিছু উপকারী পোকার পরিচয় ও সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনায় ভূমিকাঃ

আমাদের প্রকৃতিতে উপকারী পোকা অনেক রয়েছে যা বিভিন্ন ভাবে আমাদের ফসল উৎপাদনে, রক্ষায় সাহায্য করে থাকে। কিন্তু এখানে শুধুমাত্র যেসব পোকা বালাই নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে থাকে তাদের মধ্যে থেকে অতি পরিচিত কিছু উপকারী পোকার কথা তুলে ধরা হয়েছে। 

০১- লেডি বার্ড বিটল (Ladybird beetles or ladybug) : 

ফসলের ক্ষেতে বিশেষ করে সবজি ক্ষেতে সবচেয়ে বেশি যে উপকারী পোকাটি দেখা যায় তা হলো- লেডী বার্ড বিটল। দেখতে খুব সুন্দর বলে এদের স্থানীয়ভাবে ‘সুন্দরী পোকা’ নামে ডাকা হয়। অনেক রকম ও রঙের লেডী বার্ড বিটল সবজি ক্ষেতে দেখা যায়।

দিনের বেলা এরা অধিক সক্রিয় থাকে। ক্ষতিকারক পোকার ডিম ও ছোট ছোট কীড়াকে খেয়ে শত্রু পোকার আক্রমণ থেকে ফসলকে রক্ষা করার মাধ্যমে ফলন বাড়ায় এরা । জাব পোকা ও অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাতা শোষক পোকা যেমন সাদা মাছি, জ্যাসিড, মাকড় ইত্যাদি শিকার করে খায়। পূর্ণাঙ্গ পোকার চেয়ে বাচ্চা লেডী বার্ড বিটল বেশি সক্রিয় হয়ে থাকে।

সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনায়- পূর্ণাঙ্গ লেডি বার্ড বিটল পোকার বৈয়াম জমিতে ফসল লাগানোর পর থেকে উত্তোলন পর্যন্ত পুরো সময়ে প্রয়োগ মাত্রা অনুযায়ী নিয়মিতভাবে ফসলের জমিতে ছাড়া হয় । এই পদ্ধতিতে এক একর জমিতে ১২৫ টি পূর্ণাঙ্গ পোকার একটি বৈয়াম ও এক বিঘা জমিতে ৬৫ টি পূর্ণাঙ্গ পোকার একটি বৈয়াম এক মাস পর পর ব্যবহার করতে হয় ।( সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার জন্য এসব পোকা সরকারি কৃষি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে সংগ্রহ করতে পারবেন।)

০২- গ্রিনলেস উইং (Green lacewings): 

পূর্ণাঙ্গ পোকার রং সবুজ। এর দেহের উপর পাতলা প্রায় স্বচ্ছ জালের মত পাখাজোড়া রয়েছে যা বসা অবস্থায় তাবুর মত দেহকে ঢেকে রাখে। 

ক্ষতিকারক পোকার ডিম ও ছোট ছোট কীড়াকে খেয়ে শত্রু পোকার আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষা করে। তবে জাব পোকা খেতে খুব পছন্দ করে এই উপকারী পোকাটি । 

সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনায়- জমিতে ফসল লাগানোর পর থেকে সর্বশেষ উত্তোলন পর্যন্ত মৌসুম জুড়ে নিয়ম অনুযায়ী নিয়মিতভাবে মাঠে ছাড়তে হয়। যদি মাঠে ডিম দেওয়া হয় তবে সেক্ষেত্রে ডিমসহ কাপড়ের টুকরা গাছের ডালে বেঁধে দিতে হয়। যদি পূর্ণাঙ্গ পোকা দেওয়া হয় সে ক্ষেত্রে ফসলের মাঝে পোকার বৈয়ামের মুখ খুলে দিতে হবে যাতে পুরো মাঠে পোকা ছড়িয়ে যেতে পারে। শতক প্রতি ২০ টি এবং বিঘা প্রতি ৬০০ থেকে ৭০০টি ডিম প্রতি ১৫ দিন পর পর ব্যবহার করতে হয়। আর, বিঘা প্রতি ২০ থেকে ২৫ টি পূর্ণাঙ্গ পোকা এবং হেক্টর প্রতি ১৫০ টি পূর্ণাঙ্গ পোকার এক বৈয়াম একমাস পর পর ব্যবহার করতে হয় ।  

০৩- ব্রাকোনিড বোলতা (Braconid wasps) : 

সবজি ক্ষেতে অনেক রকম ব্রাকোনিড বোলতা দেখা যায়। উল্লেখযোগ্য উপকারী ব্রাকোনিড বোলতা হলো Bracon haebitor (ব্রাকোন হেবিটর). 

এটি অপকারী পোকার ডিম, কীড়া, পুত্তলি ও পূর্ণ বয়স্ক পোকার উপর পরজীবি হিসেবে জীবন ধারণ করে তাদের বিনষ্ট করে। একটি স্ত্রী ব্রাকন পোকা ৫০০ থেকে ১ হাজার অপকারী পোকার কীড়া পরজীবায়ন (দেহের ভেতরে ডিম পাড়ে) করতে পারে। এই পরজীবায়নকৃত কীড়া দুর্বল হয়ে যায় এবং একসময় মারা যায়। পরজীবায়নকৃত কীড়ার ভেতরে ব্রাকনের ডিম ফুটে বাচ্চা (লার্ভা) বের হয় এবং বাচ্চাগুলো কীড়ার শরীরের ভেতরের অংশ খেয়ে বাড়তে থাকে। এভাবে ব্রাকোন দ্বারা শত্রুপোকা ধ্বংস হয়।

অধিকাংশ বোলতা মাজরা পোকার ডিম বা কীড়ার উপর ডিম পাড়ে। ব্রাকোন হেবিটর বিভিন্ন রকম ফল ছিদ্রকারী পোকা বিশেষ করে বেগুনের ডগা-ফল ছিদ্রকারী, শিম ও বরবটির ফলছিদ্রকারী পোকার পরজীবী হিসেবে উপকার করে। 

সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনায়- প্রতি হেক্টর বেগুন, শিম বা বরবটির ক্ষেতে ৮০০টি থেকে ১২০০টি ব্রাকন হেবিটর বোলতা ছাড়া হয় , যা কার্যকরভাবে ফলছিদ্রকারী পোকাকে নিয়ন্ত্রণ করে।

০৪- ট্রাইকোগ্রামা (Trichogramma) : 

এটি একটি পরজীবী উপকারী পোকা। অত্যন্ত ক্ষুদ্র আকৃতির পোকা যা খালি চোখে দেখা কঠিন। 

এই পোকা মাজরা জাতীয় পোকা যেমন- বেগুন এর ডগা-ফল ছিদ্রকারী পোকা, শীমের ফল ছিদ্রকারী পোকা এসব পোকার ডিমের মধ্যে নিজেদের ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়ে ঐ অপকারি পোকার ডিমকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে ডিমগুলো নষ্ট করে দেয়। এভাবে ট্রাইকোগ্রামা অপকারি পোকা নিয়ন্ত্রণ করে ফসলের উপকার করে থাকে । 

অর্থাৎ ট্রাইকোগ্রামা পোকা ব্রাকোন হেবিটর বোলতার মতো একই ভাবে ফসলের উপকারে কাজ করে থাকে। 

সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনায়-  প্রতি হেক্টর জমিতে এক গ্রাম ট্রাইকোগ্রামা দ্বারা পরজীবী করা ডিম প্রয়োগ করা হয় । যা থেকে ৪০ হাজার ট্রাইকোগ্রামা পোকা জম্ম নেয় এবং ফসলের সকল ধরনের মাজরা পোকা নিয়ন্ত্রণ করতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে।

০৫- কানকোটারী (Earwig):

এই পোকার পেছনে চিমটার মতো অঙ্গ আছে, যা দিয়ে তারা শিকার ধরে ও শিকারকে মারতে ব্যবহার করে। স্ত্রী পোকার চিমটা বাঁকা আর  পুরুষদের চিমটা সোজা। এরা সাধারণত নিশাচর হয় এবং দিনের বেলায় ছোট, অন্ধকার এবং প্রায়শই আর্দ্র জায়গায় লুকিয়ে থাকে। 

কানকোটারীর কিছু প্রজাতি সক্রিয়ভাবে আর্থ্রোপড শিকার করে থাকে। এগুলোর মধ্যে ফলের সাইলা নিম্ফ, জাব পোকা ও নরম দেহের বিভিন্ন পোকা- মাজরা পোকার কীড়া ও পাতা মোড়ানো পোকার কীড়া খায়। এরা গাছের কান্ড,পাতায় লুকিয়ে থাকা মাজরা পোকাও ধ্বংস করতে সক্ষম । দৈনিক এরা ২০-৩০টি বিভিন্ন রকমের পোকা ধরে খায়। 

০৬- প্রেইং ম্যানটিড (Praying Mantids):

এটি সবজি ক্ষেতের উপকারী পোকা। এদের দেহ সবুজ রঙের যা অনেকটা বড় আকারের ঘাস ফড়িংয়ের মত দেখতে। এরা সামনের শক্ত পা দুটো  প্রার্থনার ভঙ্গিতে সব সময় ভাঁজ করে রাখে, তাই এমন নাম।‌ এরা ফসলের উপকার স্বরুপ বিভিন্ন ধরনের পাতা ফড়িং, ঘাস ফড়িংয়ের বাচ্চাসহ নানান রকমের ক্ষতিকর পোকা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। 

০৭- ড্যামসেল ফ্লাই (Damselfly):

এই পোকা জীবনের প্রাথমিক অবস্থায় জলে বাস করে। এসময় এরা বিভিন্ন ধরনের পাতা ফড়িং,গাছ ফড়িং এর বাচ্চা ধরে খাওয়ার জন্য ধান গাছ বেয়ে উঠতে পারে । পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় জল থেকে উঠে আসে ও খোলস পরিবর্তন করে ডানা অর্জন করে । তখন ফসলের ক্ষেতে উড়ে বেড়ায় ও বিভিন্ন ধরনের পোকা শিকার করে খায় ।

০৮- মিরিড বাগ (Mirid Bug): 

মিরিড বাগের অনেক প্রজাতি নরম দেহের ক্ষতিকর পোকামাকড় কে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। এরা বাচ্চা ও পূর্ণ বয়স্ক বাদামি গাছ ফড়িং, সাদা পিট গাছ ফড়িং, সবুজ পাতা ফড়িং ও এদের ডিম খেয়ে থাকে । 

০৯- পরভোজী মাকড়:

ফসলের মাঠে বিভিন্ন ধরনের মাকড়সা পাওয়া যায়। এদের মধ্যে কিছু আছে যারা জাল তৈরি না করেই শিকার ধরে খায়। মাকড়সা ক্ষতিকর ক্ষুদ্র মাকড়সহ (মাইট) অন্যান্য অপকারি পোকার ডিম, কীড়া, পুত্তলি ও পূর্ণ বয়স্ক পোকা শিকার করে খায় ।  সাধারণত এরা মাজরা পোকা, গাছ ফড়িং, পাতা ফড়িং, মাছি পোকা, এফিড ধরে খায়।

১০- সিরফিড মাছি (Syrphid Flies):

এরা অপকারি পোকা দমনের পাশাপাশি ফুলের পরাগায়নেও সাহায্য করে থাকে । এরা সাধারণত ফসলের জাব পোকা, স্কেল পোকা ও চোষক পোকা (থ্রিপস) শিকার করে খায়। এরা বাচ্চা অবস্থায়ও শিকার করে থাকে। বাচ্চারা পাবিহীন, চ্যাপ্টা দেহের, মাথার দিক সুচাল থাকে আর পূর্ণাঙ্গ মাছিতে হলদে বাদামি ডোরাকাটা দাগ থাকে।  

১১- ক্যারাবিড বিটল (Carabid Beetle):  

বিটল জাতীয় পোকার মধ্যে ক্যারাবিড বিটল অন্যতম উপকারী পোকা। এরা ফসলের ক্ষতিকর বাদামি গাছ ফড়িং. সাদা গাছ ফড়িং, পাতা মোড়ানো পোকার কীট ও অন্যান্য পোকা শিকার করে খায়। এরা পূর্ণবয়স্ক ও কীড়া উভয় অবস্থায়ই ক্ষতিকর পোকা দমন করে ।

১২- অ্যানথোকোরিড বাগ (Anthocorid Bugs):

রা জাব পোকা, সাইলা, স্কেল, থ্রিপস, ক্ষুদ্র মাকড়,  ও অন্যান্য নরম দেহের পোকা শিকার করে খায় ও বিভিন্ন পোকার ডিমও ধ্বংস করে থাকে। পূর্ণাঙ্গ পোকাকে অনেক সময় ক্ষুদ্র পাইরেট বাগ (minute pirate bug) নামে ডাকা হয়। এদের দেহ সরু,মাথা সোচালো, চ্যাপ্টা ও মসৃণ দেহ, পিঠে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দাগ রয়েছে। 

Leave a Reply