বাগানী হিসেবে সফল হওয়ার জন্য, বীজের অঙ্কুরোদগমের উপর দক্ষতা অর্জন আব্যশিক। কিন্তু সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় অনেকেই ব্যর্থ হয় এবং এক সময় বাগানের প্রতি অনিহা জন্ম নেয়। এখানে ৩ টি খুবই সহজ ও কার্যকরী পদ্ধতি তুলে ধরা হয়েছে, যা থেকে সবোর্চ্চ সংখ্যক বীজ জার্মিনেশন করা সম্ভব।
সূচিপত্র-
- বীজের অঙ্কুরোদগম সম্পর্কিত সাধারণ তথ্য
- টিস্যু পেপার পদ্ধতিতে বীজ অঙ্কুরোদগম
- মাটিতে বীজ অঙ্কুরোদগম
- মাটি বিহীন কোকোপিটে বীজ অঙ্কুরোদগম
- বীজ থেকে সবোর্চ্চ চারা উৎপাদন পদ্ধতি
- কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
বীজের অঙ্কুরোদগম সম্পর্কিত সাধারণ তথ্য
একেক উদ্ভিদের একেক রকম বীজ- এগুলোর আকারে, বর্ণে, ওজনে, গঠনে ভিন্নতা রয়েছে। তুলনামূলক ভাবে বড় আকারের বীজের অঙ্কুরোদগম সহজে করা গেলেও অতি ক্ষুদ্র বীজে সমস্যা বেশি হয়। ক্ষুদ্র বীজের ক্ষেত্রে পানি, তাপ ও আলোর তারতম্য হলে অঙ্কুরোদগম ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। যে সব বীজের খোলস অনেক পুরো হয়ে থাকে সেসবের অঙ্কুরোদগমে অনেক সময় লাগে, যেমন- পেঁপে, পুঁই শাক, ঢেঁড়স, করলা, লাউ, সেগুন কাঠের বীজ ইত্যাদি।
প্রথমত পুষ্ট ও অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা সম্পন্ন বীজ বাছাই করে নিতে হবে এবং অধিক ফলাফল পাওয়ার জন্য একটি পূর্ব কাজ করে নিতে হবে। তা হলো- প্রথমে বীজ গুলো এক ঘণ্টার মতো সময় মাঝারি তাপের রোদে রেখে দিতে হবে তারপর ৮-১২ ঘন্টা (বীজ অনুযায়ী সময় ভিন্ন হয়) পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। রোদে দিলে বীজের সুপ্ত অবস্থা দ্রুত ভেঙে যায়।
বীজ জার্মিনেশন/বপন এর আগে শোধন করে নেওয়া দরকার। বীজে কিছু জীবাণু সুপ্ত অবস্থায় থেকে যায়। এগুলো বীজের অংকুর বের হলে বা ছোট চারা গাছ হলে তখন সক্রিয় হয়ে আক্রমণ করে। বীজ শোধন এর মাধ্যমে- অ্যানথ্রাকনোজ, ব্লাইট, উইল্ট, গোড়া পঁচার মতো রোগ নিয়ন্ত্রণ ও চারা গাছে এগুলোর সংক্রমণ কিছুটা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।(বিঃদ্রঃ বাজার থেকে কেনা প্যাকেটজাত বীজ গুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শোধন করা থাকে )বীজ শোধন পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত জানতে পড়ুন-ভিডিও টিউটোরিয়াল- video place here
টিস্যু পেপার পদ্ধতিতে বীজ অঙ্কুরোদগম
টিস্যু পেপার দিয়ে বীজ জার্মিনেশন এর ভিডিও টিউটোরিয়াল দেখুন- video place hereনতুন বাগানিদের জন্য এই পদ্ধতি বেশ উপযোগী তাপমাত্রা ও আদ্রর্তা সঠিক মাত্রায় না থাকায়, শীতের সময় বীজ অঙ্কুরোদগমে সমস্যা হয়। এর একটি সমাধান হলো টিস্যু পেপার পদ্ধতিতে বীজ জার্মিনেশন। টিস্যু পেপার দিয়ে বীজ জার্মিনেশন অত্যন্ত সহজ এবং জার্মিনেশন স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করা যায়। এজন্য বীজ জার্মিনেশন রেট পরীক্ষা করার জন্যও এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। পদ্ধতির ধাপসমূহ –
- বীজ গুলো ৮-১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। বীজের আকার ও খোলসের পুরুত্বের উপর ভিত্তি করে এই ভিজিয়ে রাখার সময় কম বেশি করতে হবে
- পানি থেকে বীজ গুলো তুলে অতিরিক্ত পানি ঝরিয়ে নিতে হবে
- একটা ঢাকনা সহ বায়ুরোধী বক্স (Air tight box) নিতে হবে
- বক্স এর তলায় এক স্তর টিস্যু পেপার বিছিয়ে দিয়ে, স্প্রে করে পানি দিয়ে বা ফুটায় ফুটায় পানি দিয়ে পেপার টি ভিজিয়ে দিতে হবে। এমন ভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে যেন শুধু টিস্যু পেপার টুকুই ভিজে আর যদি অতিরিক্ত পানি বক্স এর তলায় থাকে তাহলে তা ফেলে দিতে হবে
- ভেজানো টিস্যু পেপার এর উপর বীজ গুলো বিছিয়ে দিতে হবে এবং আর এক স্তর ভেজা টিস্যু পেপার দিয়ে বীজ গুলো ঢেকে দিতে হবে
- তারপর বক্স টি ১-২ ঘন্টা হালকা রোদে রেখে দিতে হবে
- রোদে দেওয়ার পর বক্স টি ঘরের অন্ধকার-শুষ্ক জায়গায় রেখে দিতে হবে। এক্ষেত্রে রঙিন কাপড় বা পেপার দিয়ে বক্স টি ঢেকে দেওয়া যেতে পারে
- ২-৩ দিন পর(কি ধরনের বীজ এর উপর সময় নির্ভর করবে), বক্স এর ঢাকনা স্বচ্ছ হলে বাইরে থেকে দেখেই বুঝা যাবে বীজ জার্মিনেট শুরু হয়েছে কিনা
- টিস্যু পেপার এর পানি শুকিয়ে গেছে কিনা তা দেখতে হবে। পানি শুকিয়ে গেলে আবার স্প্রে করে পানি দিতে হবে।
- 50 এর মতো বীজ জার্মিনেট হয়ে গেলে সবগুলো বীজ গুলো সংগ্রহ করে নিতে হবে
- পরে কাঙ্ক্ষিত পাত্র বা বীজতলার মাটিতে সামান্য গর্ত করে বীজ গুলো রেখে দিয়ে অল্প মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। অতঃপর ১-২ দিনের মধ্যে চারা বের হওয়া আরম্ভ হবে। অঙ্কুরোদগম করা বীজ থেকে চারা হওয়ার সম্ভাবনা ৯৫% এর বেশি।
সর্তকতা- বীজ থেকে শিকড়(অংকুর) বের হওয়া শুরু হওয়া মাত্রই বীজ গুলো বীজতলায়/মাটিতে বপন করে দেওয়া উচিত। কারণ, অংকুর বেশি বড় হয়ে গেলে তখন মাটিতে বপন করলে দুর্বল চারা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
যেসব বীজ এই পদ্ধতিতে জার্মিনেট করা যাবে:
- শাক- কলমি শাক, পুঁই শাক
- সবজি- মরিচ, টমেটো, বেগুন, শসা, শীম, লাউ, করলা, কুমড়া, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মটরশুটি ইত্যাদি
- ফুল- সূর্যমুখী, মরু গোলাপ (Adenium), অপরাজিতা, সন্ধ্যামালতি, ক্যালেন্ডুলা, দোপাটি ইত্যাদি
- ফল- লেবু, কমলা, খেজুর, আপেল ইত্যাদি
অর্থাৎ- অতি ক্ষুদ্র বীজ যেমন- লালশাক, ডাটা শাক, পাট শাক, ক্ষুদ্র ফুল বীজ এবং বড় আকারের বীজ যেমন- আম,লিচু এই পদ্ধতির জন্য উপযোগী নয়।
মাটিতে বীজ অঙ্কুরোদগম
এই পদ্ধতিতে সাধারণ ভাবে মাটিতে বীজ ছিটিয়ে দেওয়া হয়। তবে এর জন্য মাটি বিশেষ ভাবে তৈরি করে নিতে হয়। মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে জৈব উপাদান মিশাতে হয়। এই পদ্ধতিতে যেকোনো ধরনের বীজ জার্মিনেট করা যাবে।
ধাপসমূহ –
- মাটি তৈরি- ৪০% দোঃআঁশ মাটি+৩০% কোকোপিট+৩০% গোবর কম্পোস্ট বা ভার্মি কম্পোস্ট একসাথে মেশাতে হবে। উপাদান গুলো ভালো করে মিশিয়ে কড়া রোদে রেখে সম্পূর্ণ রুপে শুকিয়ে নিতে হবে।
- প্রথমে বীজ গুলো ৮-১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে (বীজ অনুযায়ী সময় ভিন্ন হয়)
- কম গভীরতার চওড়া সাইজের পাত্র নিতে হবে, মাটির পাত্র হলে সবচেয়ে ভালো হয়। আগে থেকে তৈরি করা মাটি দ্বারা পাত্র পূরণ করে নিয়ে অল্প পানি স্প্রে করে বা ছিটিয়ে মাটি ভিজিয়ে নিতে হবে
- তারপর ভেজা মাটিতে অল্প গর্ত করে বীজ দিয়ে গর্ত মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে (বড় বীজ এর জন্য) আর ছোট সাইজের বীজ এর জন্য ছিটিয়ে দিয়ে অল্প মাটি দিয়ে বীজ ঢেকে দিতে হবে
- আবার পানি প্রয়োগ করে মাটি ভালো করে ভিজিয়ে দিতে হবে। (শুধু পানি প্রয়োগ না করে ছত্রাকনাশক মিশ্রিত পানি প্রয়োগ করলে অধিক বীজ অঙ্কুরিত হয় ও ছোট চারার গোড়া পঁচা রোগ দমন হয়)
- তারপর পাত্র কালো রং এর পলিথিন বা খবরের কাগজ দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এভাবে ঢেকে দেওয়ার কারণ, যেনো আদ্রর্তা বজায় থাকে। আদ্রর্তা বীজ জার্মিনেশনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। সঠিক আর্দ্রতা না পেলে বীজ জার্মিনেট করে না।
- এর পর পাত্র খোলা জায়গায় রাখা যাবে না এবং বৃষ্টিতে ভেজানো যাবে না। আলো পূর্ণ জায়গায় এবং অনেক স্যাঁতস্যাঁতে জায়গাতেও রাখা যাবে না। কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গায় রেখে দিতে হবে।
- ৩-৪ দিন পরে দেখতে হবে বীজ জার্মিনেট হলো কিনা। মাটি শুকিয়ে গেলো কিনা সেটাও দেখতে হবে এবং প্রয়োজন হলে পানি দিতে হবে।
- অধিকাংশ বীজ জার্মিনেট হয়ে গেলে পাত্রের ঢাকনা সরিয়ে ফেলতে হবে এবং পাত্রটিকে আলো বাতাস পূর্ণ স্থানে রাখতে হবে। তারপর চারা বড় হওয়ার উপর ভিত্তি করে রোদ ও রোদের সময়কাল বৃদ্ধি করতে হবে।
মাটি বিহীন কোকোপিটে বীজ অঙ্কুরোদগম
কোকোপিটে বীজের জার্মিনেশন হার মাটির চেয়ে বেশি। কারণ, কোকোপিট স্বাভাবিক ভাবে ছত্রাকরোধী ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও মাটির চেয়ে আর্দ্রতা ধরে রাখার ক্ষমতা বেশি। এসব কিছু বীজ অঙ্কুরোদগমে অধিক সহায়তা করে।
এই পদ্ধতিতে মাটির পরিবর্তে কোকোপিট ব্যবহার করা হয়। তবে ১০০% কোকোপিট ব্যবহার করা যাবে না। কোকোপিট এর সাথে ২০-৩০% হারে গোবর কম্পোস্ট বা ভার্মি কম্পোস্ট সার মেশাতে হবে। কোকোপিট+ভার্মি কম্পোস্ট মিক্স মিডিয়া তৈরি করে নেওয়ার পর বাকি কাজ কর্ম সব “মাটি দিয়ে বীজ জার্মিনেশন পদ্ধতির মতো”। তবে এক্ষেত্রে মাটির মতো কোকোপিট কে কড়া রোদে শুকাতে হবে না।
সতর্কতা: বাড়িতে বানানো কোকোপিট হলে অব্যষই প্রসেস করে ভালো করে পঁচিয়ে নিতে হবে। প্রসেস করার জন্য ২-৩ মাস পানিতে রেখে পঁচিয়ে নিতে হয়। বাজার থেকে কেনা কোকোপিট প্রসেস করা থাকে। সেটা সরাসরি ব্যবহার করা যাবে।
আরও পড়ুন-
বীজ থেকে সবোর্চ্চ চারা উৎপাদন পদ্ধতি
বীজ থেকে চারা উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবোর্চ্চ সফল হতে হলে প্রথমে বীজ গুলোকে টিস্যু পেপার পদ্ধতিতে জার্মিনেট করে নিতে হবে। তারপর, জার্মিনেট করা বীজ গুলো কোকোপিট দিয়ে তৈরি চারা করার মাটিতে (কোকোপিট ভার্মি) দিতে হবে। এতে করে সবোর্চ্চ চারা এবং রোগমুক্ত, সুস্থ সবল চারা উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর – (FAQ):
১. কোকোপিট এর পরিবর্তে কাঠের ভুসি বা কোকোপিট এর সাথে কাঠের ভুসি মেশানো যাবে?
উত্তর- কাঠ চিরার করাত কল থেকে সংগৃহীত কাঠের ভুসি কোকোপিট এর সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করা যাবে না। কাঠের ভুসির এন্টিফাংগাল গুণ নেই কোকোপিটের মতো। তাই, কাঠের ভুসি সহজেই ছত্রাকের জন্ম দিবে।
২. সরাসরি কাঁচা গোবর বা কাঁচা গোবর শুকিয়ে ব্যবহার করা যাবে ?
উত্তর- বীজ জার্মিনেশন এর জন্য গোবর ব্যবহার করলে গোবর অব্যষই ১-১.৫ বছরের পুরনো হতে হবে। গোবর ডিকম্পোস্ট করে পরে ব্যবহার করতে হবে এজন্য কাঁচা গোবর ব্যবহার করা যাবে না।
