শীতের ফুল গাছের চারা তৈরি|বীজ থেকে চারা করার সহজ পদ্ধতি

অনেক বাগানীর কাছে বীজ থেকে শীতের ফুল এর চারা করা চ্যালেন্জ স্বরুপ। আবার শীতকালীন বাহারি ফুলের চাষের ক্ষেত্রে বীজ থেকে চারা করা জরুরি, কারণ নার্সারি থেকে চারা সংগ্রহ করা ঝামেলা পূর্ণ ও ব্যয়বহুল এবং কাংখিত ফুলের চারাও পাওয়া যায় না ঠিক মতো ।তাই, এখানে বীজ থেকে চারা করার সহজ ও সবোর্চ্চ সফল হওয়ার পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো।

সূচিপত্র – 

  • কিছু শীতকালীন ফুল এর নাম ও তাদের বীজ এর পরিচিতি
  • বীজ সংগ্রহের কিছু পূর্ব শর্ত 
  • মাটি তৈরি পদ্ধতি 
  • চারা তৈরির মূল কাজ-কর্ম 
  • চারার প্রথম প্রতিস্থাপন নিয়ে কিছু কথা
  • কিছু সমস্যা, রোগ-বালাই ও সমাধান

কিছু শীতকালীন ফুল এর নাম ও তাদের বীজ এর পরিচিতি : 

নানান রং এর , নানান আকারের শীতের ফুল রয়েছে। মৌসুমী ফুল এর মধ্যে শীতকালীন ফুল গুলোই রং বৈচিত্র্য বেশি লক্ষ্য করা যায় , আবার একই ফুলের অনেক ভ্যারাইটি পাওয়া যায়। এসব ফুল গুলোর গাছ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ছোট সাইজের হয়ে থাকে এবং জীবনকালও অনেক কম হয়ে থাকে। 

এখানে বীজ এর সাইজ এর উপর ভিত্তি করে শীতের ফুল কে তিন ভাগে ভাগ করে নাম উল্লেখ করা হলো।

১. একদম ক্ষুদ্র আকৃতির বীজ –

 পিটুনিয়া,সাইলোসিয়া,নয়নতারা,লিসেনন্থাস (নন্দিনী),পেন্জি,এন্টিরাইনাম,পর্তুলিকা(হাইব্রিড), ভারবেনা,ডায়েন্থাস,সিনেরারিয়া,গাজানিয়া,পেন্জি, চন্দ্রমল্লিকা , ইত্যাদি ।  

২. মাঝারি আকারের বীজ – 

গাঁদা, কসমস,ক্যালেন্ডুলা,ফ্লক্স, জিনিয়া,এস্টার,লুপিন

৩. কিছুটা বড় আকৃতির বীজ – সৃর্যমুখী,মনিংগ্রোরি,হলিহক

বীজ এর আকার এর উপর বীজ থেকে চারা করার পদ্ধতির কিছু কাজ-কর্ম নির্ভর করে। এজন্য বীজ এর আকার সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য উক্ত আলোচনা। 

বীজ সংগ্রহের কিছু পূর্ব শর্ত : 

বীজ এর জার্মিনেশন অনেক গুলো বিষয়ের উপর নির্ভর করে। বীজ থেকে চারা করার পদ্ধতি ঠিক থাকলেও যদি বীজ নষ্ট থাকে তাহলে কোন চারা হবে না। তাই, কিছু বিষয় এর প্রতি অব্যষই খেয়াল রাখতে হবে বীজ সংগ্রহের সময় । 

  • ভালো কোম্পানির বীজ সংগ্রহ করতে হবে। জার্মিনেশন রেট ভালো এমন রিভিউ দেখে বীজ ক্রয় করতে হবে।
  • প্যাকেটে বীজ এর মেয়াদ উত্তীর্ণ তারিখ খেয়াল করতে হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ বীজ কোন ভাবেই ক্রয় করা যাবে না। 
  • কোন কোম্পানির বা সেলারের বীজের প্রতি সন্দেহ থাকলে প্রথমে কিছু পরিমাণ বীজ কিনে তার জার্মিনেশন রেট পরীক্ষা করে নিতে পারেন। তারপর ফলাফল অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যাবে । জার্মিনেশন রেট পরীক্ষা করার জন্য সহজ উপায় হলো টিস্যু পেপার পদ্ধতি ।
  • নিজের গাছ থেকে উৎপাদিত বীজ সংগ্রহ করে রাখলে তা সঠিক উপায়ে সংরক্ষণ করতে হবে। তবে সাজেশন হলো সংরক্ষিত বীজ থেকে চারা করার আগে, প্রথমে কিছু পরিমাণ বীজ নিয়ে তার জার্মিনেশন রেট পরীক্ষা করা । 

মাটি তৈরি পদ্ধতি:

শীতের ফুল গাছের বীজ থেকে চারা করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হলো বীজতলার জন্য সঠিক মাটি তৈরি। বীজের জার্মিনেশন অনেকটাই এই মাটির উপর নির্ভর করে । নিচে কিছু মাটি তৈরি পদ্ধতি দেওয়া হয়েছে, আপনারা সুবিধামত যেকোন একটি নিয়মে মাটি তৈরি করে নিবেন। 

পদ্ধতি -১: দোআঁশ মাটি ১ ভাগ, কম্পোস্ট ( গোবর সার বা ভার্মি কম্পোস্ট) ১ ভাগ, কোকোপিট ১ ভাগ।

পদ্ধতি -২: দোআঁশ মাটি ৩০%, কোকোপিট ৩০%, কম্পোস্ট ( গোবর সার বা ভার্মি কম্পোস্ট) ৩০% , নদীর লাল বালু ১০% ।

পদ্ধতি -৩(soil less): কোকোপিট ৫০%, ভার্মি কম্পোস্ট ৩০%, নদীর লাল বালু ২০% ।

এভাবে পরিমাণ মতো উপাদান নিয়ে একসাথে মিশিয়ে মিক্স তৈরি করতে হবে। মিক্স এর উপাদান গুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানায় পরিণত করতে হবে, অনেক সময় মাটির অনেক বড় বড় দানা থাকে। 

এরপর মিক্স টি কড়া রোদে রেখে একদম শুকিয়ে নিতে হবে। যত বেশি শুকনো হবে ততো ভালো। 

চারা তৈরির মূল কাজ: 

চারা করার জন্য চওড়া পাত্র বাছাই করে নিতে হবে। এরজন্য ৩-৪ ইঞ্চি গভীরতার মাটির চওড়া পাত্র সবচেয়ে ভালো। প্রথম অবস্থায় সিডলিং ট্রে ব্যবহার করা ঠিক হবে না, কারণ অধিকাংশ শীতের ফুল বীজ অনেক ছোট হয়ে থাকে। 

  • পাত্রে, আগে থেকে তৈরি করা মিডিয়া মিক্স ( মাটির মিশ্রণ) দিয়ে ভরে দিতে হবে । পাত্রের উপরের দিকে ১ ইঞ্চি বা হাফ ইঞ্চি পরিমাণ খালি রেখে মাটি দ্বারা পূরণ করতে হবে । পাত্রের নিচের ছিদ্রের ব্যবস্থাপনা ভালো ভাবে করতে হবে। 
  • মিডিয়া মিক্স, পানি দিয়ে ভালো করে ভিজিয়ে নিতে হবে । এখানে শুধু পানি ব্যবহার না করে পানির সাথে ছত্রাকনাশক পাউডার মিশিয়ে সেই পানি ব্যবহার করতে হবে। 
  • এবার ফুল বীজ ( ক্ষুদ্র আর মাঝারি সাইজের) ছিটিয়ে দিতে হবে । বড় সাইজের বীজ হলে মাটিতে আঙ্গুল দিয়ে একটু গর্ত করে সেখানে একটি করে বীজ দিতে হবে। 
  • তারপর সেই একই মাটির মিক্স দিয়ে একটি লেয়ার  মতো তৈরি করে বীজ গুলোকে ঢেকে দিতে হবে। বেশি মাটি দেওয়া যাবে না শুধু বীজ গুলো ঢাকা পড়বে এমন হলেই চলবে। 
  • এরপর স্প্রে করে পানি দিতে হবে যেনো বীজ ঢেকে দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত মাটি টুকু ভিজে যায়।
  •  এরপর একটি খবরের কাগজ-পত্রিকা বা রঙিন-কালো পলিথিন দিয়ে পাত্রের মুখ টি ঢেকে দিয়ে সুতা দিয়ে বেঁধে দিতে হবে । এরপর কিছুটা অন্ধকার এমন জায়গায় পাত্রটি রেখে দিতে হবে ৩-৪ দিন ।
  • সাধারণ ৩-৪ দিন পর ( এই সময় ফুল বীজ এর উপর নির্ভর করবে, একেক রকম বীজ একেক সময় নিয়ে জার্মিনেশন হয় ) পাত্রের ঢাকনা টি সরিয়ে দেখতে হবে যে বীজ জার্মিনেশন করা শুরু হয়েছে কিনা। যদি অর্ধেক বীজ জার্মিনেশন হয়ে গেছে এমন মনে হয় তাহলে খবরের কাগজ বা পলিথিন এর ঢাকনা সরিয়ে ফেলতে হবে। তারপর পাত্রটি হালকা আলো ছায়া যুক্ত স্থানে রাখতে হবে। 
  • এরপর আস্তে আস্তে আলো-রোদের সময় বৃদ্ধি করতে হবে চারা বৃদ্ধির সাথে সাথে । মোটামুটি ১০-১২ দিন পর পূর্ণ আলো-রোদ যুক্ত জায়গায় চারা গুলো রাখা যাবে । 
  • উৎপাদিত চারায় ৩-৪ টা পূর্ণ পাতা হওয়া পর্যন্ত উক্ত পাত্রে রেখে দিতে হবে। তারপর চারা প্রথম প্রতিস্থাপন করতে হবে । 
  • প্রথম প্রতিস্থাপন এর ২০-২৫ দিন পর চারা গুলো মূল টব/পাত্রে লাগানোর উপযোগী হবে ।  

চারার প্রথম প্রতিস্থাপন নিয়ে কিছু কথা: 

চওড়া পাত্রে একসাথে অনেক চারা করে তারপর সেই ছোট চারা গুলোকে সরাসরি মূল টব/পাত্রে স্থানান্তর করা যাবে না। চারা গুলোকে একবার স্থানান্তর করে আরও কিছুটা বড় করে নিতে হবে। 

  • চওড়া পাত্র থেকে চারা তুলার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। মাটিতে বেশি করে পানি দিয়ে নরম করে নিতে হবে এতে চারা উঠানো সহজ হবে। কোন কাঠির সাহায্যে ধীরে ধীরে যতটুকু সম্ভব কম শিকড় ক্ষতিগ্রস্ত করে চারা গুলো তুলতে হবে। 
  • ছোট চারা গুলোকে ১-২ ইঞ্চি টব বা ২×২ সাইজের সিডলিং ট্রে বা ছোট চা-কফি খাওয়ার ওয়ান টাইম কাপে (একটি পাত্রে একটি করে) স্থানান্তর করতে হবে । 
  • এসময় মাটি তৈরির জন্য ৫০% দোআঁশ মাটি, ৩০% কম্পোস্ট ( গোবর সার বা ভার্মি কম্পোস্ট) আর ২০% কোকোপিট বা নদীর লাল বালু ব্যবহার করতে হবে। এই মাটি মিক্স টব, সিডলিং ট্রে তে ব্যবহার করতে হবে। 
  • টব বা সিডলিং ট্রেতে চারা গুলো ১৫-২৫ দিন রাখতে হবে। এতে চারা গুলো শক্ত সামর্থ্য হবে, আরও কিছুটা বড় হবে । 
  • এসময় অনেক শীতের ফুল চারায় কলি, ফুল চলে আসতে পারে। এই ফুল, কলি নিয়মিত ছাঁটাই করে দিতে হবে । আবার মূল ডগা এসময়ই ছাটাই করে দিতে হবে । এতে গাছে অধিক ডাল-পালা হবে তথা পরবর্তীতে গাছ অনেক ঝোপালো হয়ে অনেক বেশি ফুল দিবে । 
  • ১৫-২৫ দিন পর চারা গুলো চাহিদা মতো বড় মূল পাত্রে/টবে ফাইনাল স্থানান্তর করতে হবে।

চারার কিছু সমস্যা, রোগ-বালাই ও সমাধান: 

১. ছোট চারা অনেক সময় পাখি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই চারা গুলো পাখি থেকে দূরে বা পাখি রোধী নেট দিয়ে ঢেকে দিতে হবে ।

২. চারা গজানোর পর আলো না পেলে চারা গুলো হালকা-পাতলা অনেক লম্বা হয়ে পরে । এজন্য চারা গজানোর পর আর ঢেকে রাখা যাবে না । তখন চারা গুলোর জন্য যতটুকু সম্ভব রোদ বিহীন উজ্জ্বল আলোর ব্যবস্থা করতে হবে । তারপর আস্তে আস্তে চারা বৃদ্ধির সাথে সাথে রোদ-আলোর পরিমাণ বাড়াতে হবে।

৩. মাটিতে সবসময় ভিজা ভিজা ভাব থাকে এমন রাখতে হবে। এজন্য উপরের মাটি কিছুটা শুকনোর মতো হলে নিয়মিত স্প্রে করে পানি দিতে হবে ‌। মাটিকে সবসময় ময়েশ্চ রাখতে হবে। 

৪. ছোট চারার একটা সমস্যা হলো গোড়া পঁচা রোগ। এতে অনেক চারা নষ্ট হয় । এর জন্য চারা গজানোর ৭-১০ দিন এর সময় ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে। (কার্বন্ডাজিম + ম্যানসার) এজাতীয় মিক্স ছত্রাকনাশক পাউডার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এক লিটার পানিতে কত টুকু ছত্রাকনাশক মেশাতে হবে তা প্যাকেট এর গায়ে লেখা থাকে। 

৫. চারায় অনেক সময় পাতাখেকু নানান পোকার আক্রমণ হয় । এরজন্য প্রত্যেক সপ্তাহে একবার করে নিম তেল স্প্রে করে যেতে হবে । আর আক্রমণ বেশি হলে সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। 

Leave a Reply